Wednesday, November 24, 2021

31>||মা"সর্বশক্তিময়ী "মা"

 31>||"মা"সর্বশক্তিময়ী "মা"🔱*


শাক্তেরা জগতের সেই  সর্বব্যাপিনী শক্তিকে "মা" ব’লে পূজা ক’রে থাকেন,

কারণ মা-নামের চেয়ে মিষ্ট নাম আর নাই। প্রেমের উচ্চতম বিকাশরূপে পূজা করাকে হিন্দুরা ‘দক্ষিণাচার’ বা ‘দক্ষিণমার্গ’ বলেন, ঐ উপাসনায় আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়, মুক্তি হয়—এর দ্বারা কখনও ঐহিক উন্নতি হয় না।  আর "মা"এর ভীষণ রূপের, রুদ্রমূর্তির উপাসনাকে ‘বামাচার’ বা  ‘বামমার্গ’ বলে; সাধারণতঃ এতে সাংসারিক উন্নতি খুব হ’য়ে থাকে, কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতি বড় একটা হয় না। কালে ঐ থেকে অবনতি এসে থাকে, আর যারা ঐ সাধন করে, সেই জাতির একেবারে ধ্বংস হ’য়ে যায়। জননীই শক্তির প্রথম বিকাশ-স্বরূপ, আর "জনকের" ধারণা থেকে "জননীর" ধারণা ভারতে উচ্চতর বিবেচিত হ’য়ে থাকে। "মা"-নাম করলেই শক্তির ভাব সর্বশক্তিমত্তা, ঐশ্বরিক শক্তির ভাব এসে থাকে, শিশু যেমন নিজের মাকে সর্বশক্তিময়ী মনে ক’রে ভাবে—"মা" সব করতে পারে। সেই জগজ্জননী ভগবতীই আমাদের অভ্যন্তরে নিদ্রিতা কুণ্ডলিনী—তাঁকে উপাসনা না ক’রে আমরা কখনই নিজেদের জানতে পারি না। সর্বশক্তিমত্তা, সর্বব্যাপিতা ও অনন্ত দয়া সেই জগজ্জননী ভগবতীর গুণ।  জগতে যত শক্তি আছে, তিনিই তার সমষ্টিরূপিণী। জগতে যত শক্তির বিকাশ দেখা দেয়, সবই সেই "মা"। তিনিই প্রাণরূপিণী, তিনিই বুদ্ধিরূপিণী, তিনিই প্রেমরূপিণী। তিনি সমগ্র জগতের ভিতর রয়েছেন, আবার জগৎ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক্‌। তিনি একজন ব্যক্তি, তাঁকে জানা যেতে পারে এবং দেখা যেতে পারে  (যেমন ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁকে জেনেছিলেন ও দেখেছিলেন)। 

সেই জগন্মাতার ভাবে প্রতিষ্ঠিত হ’য়ে আমরা যা খুশি তাই করতে পারি। তিনি অতি সত্ত্বর আমাদের প্রার্থনার উত্তর দিয়ে থাকেন। তিনি যখন ইচ্ছা যে কোনরূপে আমাদের দেখা দিতে পারেন। সেই জগজ্জননীর নাম ও রূপ দুই-ই থাকতে পারে, অথবা রূপ না থেকে শুধু নাম থাকতে পারে। তাঁকে এই-সকল বিভিন্ন ভাবে উপাসনা করতে করতে আমরা এমন এক অবস্থায় উপনীত হই, যেখানে নাম রূপ কিছুই নেই, কেবল শুদ্ধসত্তামাত্র বিরাজিত। যেমন কোন শরীরবিশেষের সমুদয় কোষগুলি (cells) মিলে একটি মানুষ হয়, সেইরূপ  প্রত্যেক জীবাত্মা যেন এক একটি কোষস্বরূপ, এবং তাদের সমষ্টি ঈশ্বর আর সেই অনন্ত পূর্ণ তত্ত্ব (ব্রহ্ম) তারও অতীত। সমুদ্র যখন স্থির থাকে তখন তাকে বলা যায় ‘ব্রহ্ম’, আর সেই সমুদ্রে যখন তরঙ্গ ওঠে তখন তাকেই আমরা ‘শক্তি’ বা 'মা’ বলি। সেই শক্তি বা মহামায়াই দেশকাল নিমিত্ত স্বরূপ। সেই ব্রহ্মই মা। তাঁর দুই রূপ একটি সবিশেষ বা সগুণ, এবং অপরটি নির্বিশেষ বা নির্গুণ। প্রথমোক্ত রূপে তিনি ঈশ্বর, জীব ও জগৎ; দ্বিতীয় রূপে তিনি অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। সেই নিবুপাধিক সত্তা থেকেই ঈশ্বর, জীব ও জগৎ এই ত্রিত্বভাব এসেছে।

 ============

*তথ্যসূত্রঃ  স্বামী বিবেকানন্দের ‘দেববাণী’ থেকে গৃহীত*

           ( সংগৃহীত)

        <---আদ্যনাথ--->

==========================

30>|| যেদিন মা সূক্ষ্ম দেহ লাভ করলেন ।।

 30> ||যেদিন মা সূক্ষ্ম দেহ লাভ করলেন  ||


শরীর যাবার আগের দিন সকাল থেকেই মায়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আমার আবার তার আগের দিন পেট খুব খারাপ হওয়াতে শরীর এত দুর্বল যে নড়বার শক্তি নেই। মহারাজ (শরৎ) আমাকে তাঁর ঘরে বসেই মাছের ঝোলভাত খেয়ে নিতে বললেন। 

এদিকে মার  শ্বাসকষ্ট এত বাড়ছে যে তাঁর সে কষ্ট যেন চোখে দেখা যায় না। একতলা থেকে তিনতলা - সারাবাড়ি সেই শব্দ শোনা যাচ্ছে। চোখদুটি যেন বেরিয়ে আসছে। মা তো কোনও বাছবিচার করেন নি। যত পাপীতাপীকে বুকে নিয়েছেন বলে তাঁর এই কষ্ট! সাধুভক্তে বাড়ী ভরে গেল। 

সারারাত্রি আমি আর সুধীরাদি মায়ের পায়ের কাছটিতে বসেছিলুম। যোগীনমা আমাকে একঘটি জলে মায়ের পায়ের কাছটিতে আঙুল ডুবিয়ে চরণামৃত করে নিতে বললেন। শ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখে ফোঁটা ফোঁটা গঙ্গাজল দিতে লাগলুম। ধীরে ধীরে শব্দ কমে আসতে লাগল, ক্রমে সব শান্ত। তখন রাত একটা বেজে গেছে। সেদিন চৌঠা শ্রাবণ (১৩২৭)।

যে মায়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না, এখন সেই মায়ের রূপ আর ধরছে না - একেবারে দুর্গাপ্রতিমার মতো!

মাকে সরু লালপেড়ে গরদের কাপড় পরিয়ে দেওয়া হলো। পরদিন বেলা এগারটায় মায়ের খাট মাথায় করে কাশীপুর হয়ে বরানগর কুঠিঘাট অবধি নিয়ে আসা হলো। আমাকে গোলাপ-মা, যোগীন-মা সঙ্গে যেতে বারণ করেছিলেন। সুধীরাদি জোর করে আমার হাত ধরে বের করে নিয়ে এলেন। তখন খুব ভগবানের নাম, হরি-সঙ্কীর্তন হচ্ছে। ওদের সঙ্গে সঙ্গে কুঠিঘাট পর্যন্ত গেলুম। সেখান থেকে মহারাজেরা ও ভক্তেরা মাকে নিয়ে একটা বড় নৌকায় উঠলেন। আমরা মেয়েরা পাশে পাশে একটা ছোট নৌকায়।

বেলা দুটোয় বেলুড়ের ঘাটে পৌঁছে মাকে আমতলায় নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর সেখানে পূজা ও ভোগ নিবেদন। পরে গঙ্গার ঘাটে মাকে স্নান করানো হবে। কাপড় দিয়ে আড়াল করা হলো। আমি আর সুধীরা-দি মায়ের শরীর তুলে নিয়ে গঙ্গার জলে রেখে তাঁকে স্নান করালুম। ইদানীং অসহ্য গায়ের জ্বালায় মা প্রায়ই বলতেন, "গঙ্গায় নিয়ে চল, গঙ্গায় নিয়ে চল।" তখন মায়ের শরীর যে কী হালকা ও নরম লাগছিল।

ঐ কাপড়খানা বদল করে তাঁকে আর একটা নতুন সরু লালপেড়ে গরদ পরানো হলো। এবার সাধুরা তাঁকে আবার আমতলায় নিয়ে গেলেন। সেখানে দ্বিতীয়বার মাকে আরতি করা হয়। আমি সব দেখলুম, মনে কিছুই হলো না। তারপর যেখানে বর্তমানে মায়ের মন্দির সেখানে চিতা সাজানো হলো। আমি আর সে দৃশ্য দেখতে পারছি না, কী দেখব? সুধীরা-দির পিছনটিতে শুয়ে পড়লুম। 

চন্দনকাঠের চিতায় মাকে শুইয়ে দিয়ে শরৎ মহারাজ ও অন্যসব মহারাজরা বেলপাতা, ধুনো ও গুগগুল প্রদক্ষিণ করে করে আহুতি দিতে লাগলেন।

প্রবোধ-দি জোর করে আমার হাত ধরে টেনে তুলে বললেন, "একবার দেখ না কী সুন্দর দেখাচ্ছে!" দেখলুম আগুনের শিখা আকাশ ছুঁয়ে কত উঁচুতে উঠেছে। তখন তো এখনকার মতো ট্রাম-বাসের সুবিধা ছিল না, তাই খুব বেশী ভিড় হয়নি। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ওপারে তখন বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু এপারে বৃষ্টি নেই।

মায়ের শরীরের কিছুই চোখে পড়ল না, কি জানি কি দেখব ভেবে এতক্ষণ চোখ তুলে তাকাইনি। এখন আমরাও প্রদক্ষিণ করে তিনবার আহুতি দিলুম। 

ফিরে...দু-তিন দিন আর উদ্বোধনে যাইনি, মন সরছিল না। ফাঁকা বাড়ি, কী দেখতে যাব? যোগীন-মা ডেকে পাঠালেন। মায়ের ঘর তখনো খালি পড়ে ছিল। সেদিকে আর তাকানো গেল না, কেবলই চোখ ফেটে জল আসছে। যোগীন-মা কাঁদছেন আর বলছেন, "তোরাও যদি না আসবি, আমরা কি করে থাকব? মা চলে গেলেন, সব শূন্য লাগছে।"

[প্রব্রাজিকা ভারতীপ্রাণা বিরচিত শ্রীশ্রীমায়ের চরণপ্রান্তে থেকে নিবেদিত]

            (সংগ্রহীত)

          <--আদ্যনাথ-->

==========================


Tuesday, November 9, 2021

29>|| ভূত চতুর্দশী' ও কিছু কথা :-

 29>||-: 'ভূত চতুর্দশী' ও কিছু কথা :- 

কার্ত্তিকমাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি 'ভূত চতুর্দশী' নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে কালীপুজো ও ভ্রাতৃদ্বিতীয়া এসবের পাশাপাশি ধনতেরস্ (ত্রয়োদশী তিথি), ছট্ পূজা, ভূত চতুর্দশীও পালনীয় দিন হিসেবে গণ্য হয়েছে।

    দীপাবলির যে পাঁচদিন মুখ্যতঃ উৎসব পালিত হয়, তার প্রথম দিনটি ধনতেরস্, দ্বিতীয় দিন ভূত চতুর্দশী এবং এরপরের দিনই দীপাবলির মুখ্য উৎসবটি হয়ে থাকে। কথিত আছে, বিজয়া দশমীর দিন শ্রীরাম লঙ্কাবিজয় করার পর কার্ত্তিকমাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে অযোধ্যায় ফিরে এসেছিলেন। তাই মহানন্দবশতঃ অযোধ্যাবাসী তাদের প্রিয় রাজকুমারের ফিরে আসার আনন্দে এই দিনটিতে সারা অযোধ্যাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করেছিলেন। সেই থেকেই এই দিনে 'দীপাবলি-উৎসব' শুরু। এই দিন পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র কালীপূজা হয়। কিন্তু, দীপাবলির সাথে কালীপূজার সম্পর্ক নেই। যেহেতু সেইদিনই অমাবস্যা থাকে, তাই অমাবস্যায় কালীপূজা হয়। 

যাই হোক, ফিরে আসা যাক মূল প্রসঙ্গে।

              হিন্দুধর্মের প্রতিটি উৎসবেরই অনেক গূঢ়তর মাহাত্ম্য থাকে, 'ভূত চতুর্দশী'- এই দিনটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এই দিনের মাহাত্ম্যও অনেক বেশি। "মূলতঃ অশুভ শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে মনোবলকে দৃঢ় রেখে লড়াইপূর্বক  শুভশক্তির জাগরণ তথা বিজয় ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা"- এটি ভূত চতুর্দশীর মূল গূঢ়-মাহাত্ম্য। 

     'ভূত চতুর্দশী' নামের দ্বারাই বোঝা যায়, ভূত,প্রেত, আত্মা, কালো জাদুবিদ্যা ইত্যাদির সাথে দিনটি ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। ভূত চতুর্দশীর রাতেই প্রত্যেক পরিবারের ১৪ টি মৃত পূর্বপুরুষের আত্মাগণ তাদের  নিজেদের  জীবিত উত্তরপুরুষ-বংশধরদের সাথে দেখা করতে আসেন। এছাড়াও বিভিন্ন আত্মারা তাদের প্রিয় ব্যক্তিদেরও দেখতে আসেন, এটাও মান্যতা।

            আসলে 'ভূত' বলতে 'যা অতীত'-এই অর্থও বোঝানো হয়। তাই আমাদের অতীত পুরুষগণ অর্থাৎ আমাদের গত পূর্বপুরুষকেও সেদিন আমরা স্মরণ করি এবং তাদের উদ্দেশ্যে সারা বাড়িতে ১৪ টি মাটির প্রদীপ   জ্বালিয়ে ঈশ্বর ও আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে থাকি। ভূত চতুর্দশীর রাতটিতে আসুরিক তথা ঋণাত্মক শক্তিসমূহ অধিক শক্তিশালী হয়। তাই আসুরিক শক্তি তথা ঋণাত্মক আত্মাদের দূরে রাখতেও সারা বাড়ি প্রদীপের আলোয় আলোকিত করা হয়। এছাড়া 'চতুর্দশী তিথি'-টি হল কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশতম দিন, তাই এই 'চতুর্দশপ্রদীপ প্রজ্বলন' তার তাৎপর্য্যও বহন করে। তেল বা ঘি দ্বারা মাটির প্রদীপ জ্বালালে তা মানব শরীরের পক্ষে উপকারী এবং তার দ্বারা গৃহে প্রবাহিত বায়ু পরিশোধিত হয়ে জীবানুমুক্ত হয়- এর বৈজ্ঞানিক সত্যতাও রয়েছে।

'রূপচতুর্দশী' নামেও এই দিনটিকে জানা যায়। এই নামটি মৃত্যুর দেবতা যমরাজের সাথে সম্পর্কিত। এই দিন সন্ধ্যায় যমরাজের জন্যও বহু বাড়িতে বাড়ির দক্ষিণদিকে একটি প্রদীপ জ্বালানো হয়ে থাকে। বলা হয়, এই দিন যমরাজের উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলে নরকের ভয় বা অকালমৃত্যুর ভয় কাটে।

পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার পাশাপাশি ভূত চতুর্দশীতে ভেষজগুণযুক্ত ১৪ টি শাকমিশ্রিত ব্যঞ্জন খাওয়া হয়ে থাকে, যা বিশেষ পুষ্টিযুক্ত। আসলে এটি শীতের প্রারম্ভে আমাদের শরীরের জন্য বিশেষ রোগ-প্রতিরোধকের কাজ করে থাকে। অনেকের মতে, ভূত চতুর্দশীর আগের দিন অর্থাৎ 'ধনতেরস্' (ত্রয়োদশী তিথি) হলো 'ধন্বন্তরী' নামক আয়ুর্বেদজ্ঞ-এর জন্মতিথি, যিনি কাশীর রাজা ছিলেন। তাঁর জন্মতিথি ত্রয়োদশী তিথির একেবারে শেষ লগ্নে, চতুর্দশীর শুরুতেই। তাই তাঁকে সন্মান জানিয়েই ও আয়ুর্বেদকে স্মরণ করেই ১৪ টি শাকমিশ্রিত ব্যঞ্জন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খাওয়া হয়ে থাকে, শীতকালের প্রারম্ভের পরিবর্তিত আবহাওয়া থেকে  সুস্থ থাকবার জন্যই। তাই এই ত্রয়োদশী দিনটিকে তাঁর নামানুসারেই 'ধন্বন্তরী তেরস্' বা 'ধন্তেরস্' বলা হয়। এছাড়াও এই দিনের সাথে ধন ক্রয় বা লাভেরও একটি সম্পর্ক আছে। যদিও অনেকের বিশ্বাস, এই দিনে সোনা-রূপা ইত্যাদি ক্রয় বা লাভ করলে অথবা মহালক্ষ্মী পুজো বা কুবেরের পুজো করলে গৃহস্থের ধন-ঐশ্বর্য্য ও শ্রী বৃদ্ধি হয়। তাই এই ত্রয়োদশী দিনটিকে হিন্দিতে 'ধনতেরস্' নামেও অভিহিত করা হয়। তাই দেশের বিবিধ প্রান্তের (বিশেষতঃ উত্তরভারত ) বহু মানুষ এই দিনে সোনা, রূপা ইত্যাদি ধনসম্পদ ক্রয় করে থাকেন এবং বিবিধ পূজাপাঠও করে থাকেন। 

 পুরাণ মতে, ভূত-চতুর্দশীর দিনই শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করেন। তাই এই দিনটি 'নরক চতুর্দশী' নামেও খ্যাত। নরকাসুর ষোলো হাজার একশোজন কন্যাকে বন্দিনী করে রেখেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ মাকালীর সহায়তায় নরকাসুরকে বধ করে তাদের মুক্ত করেন। এই কন্যাদের পিতা-স্বামীরা তাদের আর নিজের করে মেনে না নিলে, তারা লোকলজ্জায় আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন শ্রীকৃষ্ণ সকলকে পত্নীরূপে বরণ করে তাদের যোগ্য সন্মান দিয়েছিলেন। 

  আবার, মা চামুণ্ডা এই দিনেই প্রবল হওয়া আসুরিক শক্তি ও ঋণাত্মক প্রেত-আত্মাদের দূরীভূত করে থাকেন মহাকালীরূপে। এছাড়া, বছরের অন্যান্য কৃষ্ণচতুর্দশীর থেকে এই চতুর্দশী বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। তাই একে 'কালীচতুর্দশী' -ও বলা হয়। এই নামটি মাকালীর মহত্ব বা কালোতম দিন- এই দুই অর্থেই হয়ে থাকতে পারে বলেই মনে হচ্ছে।

  তাছাড়া, দিবালীর আগের দিনই যেহেতু অনেকে এই দিনেও প্রদীপ জ্বালায়, বাজি পোড়ায়, তাই দেশের কোনো কোনো জায়গায় (মূলতঃ উত্তরভারতে) একে 'ছোটী দিবালী'-ও বলে।

  গ্রামের দিকে এই দিনটিতে খুবই সাবধানে সকলে বাড়ির ভিতরেই বসবাস করেন, মনে একটি মৃদু ভয় রেখে। কারন মান্যতা আছে, এইদিন সমস্ত ঋণাত্মক শক্তি জাগরিত হয়। তান্ত্রিক সিদ্ধিও এই দিনেই অধিক ফলপ্রসূ হয়ে থাকে, এই দিন তাই দেবী কালীর পুজো করে তাতে নরবলির প্রথা এক সময় ছিল, তান্ত্রিক সিদ্ধিকে সফল করবার জন্য। প্রত্যন্ত গ্রামে বহু পূর্বে শিশুদের এই সিদ্ধিলাভের আশায় বলিপ্রদান করা হতো। নরবলির মধ্যে শিশুবলি উৎকৃষ্ট - এই অন্ধবিশ্বাস ছিল। তাই প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে শিশুদের এই দিন বাড়িতেই রাখা হতো, বেরোতে দেওয়া হতো না। যাই হোক, এই ক্রূরতম অন্ধবিশ্বাস আপাতত প্রশাসন বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে, আগামীতেও এটি বন্ধ থাকুক এই বিষয়ে তারা তৎপর। প্রশাসনের চাপে এখন নরবলি বন্ধ হওয়ায় তা ছাগবলির মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। এর দ্বারা মনস্কামনা পূরণ হয় এটি সিদ্ধতান্ত্রিকদের মত। কালোজাদুবিদ্যাও এই দিনেই অধিক প্রয়োগ করা হয়ে থাকে বলেও মত । 

  বহু শ্মশানে ও গৃহস্থে এইদিন কালীপুজোও হয়ে থাকে। মাকালীকে সুগন্ধজাতীয় দ্রব্য (যেমন- চন্দন,পুষ্প ইত্যাদি) দিয়ে পূজা দিলে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হওয়া যায়। সকল প্রকার বিঘ্নসমূহকেই বিনাশ বা দূরীভূত করে শুভ শক্তির প্রকাশের আশায় মাতৃশক্তির আরাধনা করা হয়। এই দিন দেবীর পূজার মাধ্যমে মনের আলস্য, ঈর্ষা, দ্বেষ, মোহ ইত্যাদি সকল প্রকার ঋণাত্মক ভাব ত্যাগ করে মনে ভক্তিভাব আনার চেষ্টা করা হয়ে থাকে।


🌺🙏🌺🙏🌺🙏🌺🙏🌺

28>|| কালী বা কালিকা= বর্ননা ||

          28>|| কালী বা কালিকা= বর্ননা||


কালী বা কালিকা তাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায় কালীপূজা করে থাকে। তন্ত্র অনুসারে, কালী দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত।

কালী দুর্গার ললাট থেকে উৎপন্না হয়েছেন—এই বাক্যের তাৎপর্য যে, ললাটের সংকোচনেই ক্রোধভাব প্রকাশিত হয় বলে সদা ক্রোধান্বিতা; রণরঙ্গিনী করাল-বদনা কালীকে ললাট-সম্ভবা বলা হয়েছে। বাস্তবিক কালীও দুর্গার রূপান্তর বিশেষ। ক্রোধাবস্থাপন্না শক্তিকেই কালী বলা হয়েছে।

চণ্ডবধ কালে অসুরগণ সহ যুদ্ধ করতে করতে ক্রোধভরে ভগবতীর মুখ কৃষ্ণবর্ণ হয়ে উঠার পর তাঁহার ললাটদেশ হতে করালবদন অসি-পাশ প্রভৃতি অস্ত্রপাণি কালিকাদেবীর আবির্ভাব হয়েছিল। (মার্কণ্ডেয় পুঃ ৮৭/৫)

কালিকাপুরাণে এর রূপাদি এভাবে বর্ণন আছে –

“নীলোৎপলের ন্যায় শ্যামবর্ণ, চারহাত, দক্ষিণহাত দুইটিতে খট্বাঙ্গ ও চন্দ্রহাস, বামহাত দুইটিতে চৰ্ম্ম ও পাশ, গলায় মুণ্ডমালা, পরনে বাঘের চামড়া, কৃশাঙ্গ, দাঁত দীর্ঘ, অতিভয়ঙ্কর লোলজিহবা, আরক্তচক্ষু, ভীমনাদ, কবন্ধ বাহন, বিস্তৃত মুখ ও কর্ণ স্থুল। এই দেবী তারা ও চামুণ্ডা নামেও অভিহিত হয়ে থাকেন। এর আটজন যোগিনী তাদের নাম-ত্রিপুরা, ভীষণা, চণ্ডী, কত্রী, হন্ত্রী, বিধাতৃকা, করালা ও শূলিনী। এই সকল যোগিনীগণও দেবীর সাথে পূজিত এবং অনুধ্যাত হয়ে থাকেন। দেবীগণের মধ্যে এরই পূজা করলে সৰ্ব্বকামনা সিদ্ধ হয়।” (কালিকা ৬০ অঃ)

তিনি দশ মহাবিদ্যার মধ্যে প্রথম মহাবিদ্যা। যথা তন্ত্রসারে,—

“কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।

ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধুমাবতী তথা ॥

বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।

এতা দশ মহাবিদ্যা সিদ্ধবিদ্যাঃ প্রকীৰ্ত্তিতাঃ ॥


কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধুমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা এই দশমূর্ত্তির নাম দশ মহাবিদ্যা; তাঁদের সিদ্ধবিদ্যা ও বলা হয়ে থাকে। সতী দক্ষযজ্ঞে যাবার সময় শিবের নিকট বারবার অনুমতি চাইলেন, কিন্তু মহাদেৰ কোনক্রমেই তাঁকে অনুমতি না দেওয়ায় সতী এই রূপে দশমূর্ত্তি ধারণ করে শিবকে ভীত করেছিলেন এবং তাঁর অনুমতি পেয়েছিলেন।

যত কন সতী শিব না দেন আদেশ।

ক্রোধে সতী হৈলা কালী ভয়ঙ্করবেশ ॥ (অন্নদা মঙ্গল ২৯)

কালীমূর্ত্তির ধ্যান মন্ত্র যথা-----

ওঁ করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম্।

কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুন্ডমালাবিভূষি তাম্ ॥

সদ্যশ্চিন্নশিরঃ খড়গবামাধোর্দ্ধক রাম্বুজাম্।

অভয়ং বরদঞ্চৈব দক্ষিণোদ্ধার্ধপাণিকাম্ ॥

মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব দিগম্বরীম্।

কন্ঠাবসক্তমুন্ডালী-গলদ্রুধিরচর্চিতাম্ ॥

কর্নাবতংসতানীতশ বযুগ্মভয়ানকাম্।

ঘোরদ্রংষ্টাং করালস্যাং পীণোন্নতপয়োধরাং ॥

শবনাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মখীম্।

সৃক্কদ্বয়গলদ্রক্ত-ধারাবিস্ফুরিতাননাম্ ॥

ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শ্মশ্মানালয় বাসিনীম্।

বালার্কমণ্ডলাকা রলোচনত্রিয়ান্মি তাম্ ॥

দস্তুরাং দক্ষিণব্যপিমুক্ তালম্বিকচোচ্চয়া ম্।

শবরূপমহাদেবহৃদয় োপরি সংস্থিতাম্ ॥

শিবাভির্ঘোররাবা ভিশ্চতুর্দিক্ষু সমন্বিতাম্।

মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম ॥

সুখপ্রসন্নবদনাং স্মেরানন সরোরুহাম্।

এবং সঞ্চিন্তেয়ৎ কালীং সর্বকাম- সমৃদ্ধিদাম্ ॥ (তন্ত্রসার)


দেবী দক্ষিণা কালী করালবদনা ভয়ঙ্করী, মুক্তকেশী ও চতুর্ভুজা, তিনি দিব্য জ্যোতি সম্পূর্ণা, মুন্ডমালা ধারিণী। মায়ের বামদিকের নিচের হাতে সদ্যচ্ছিন্নিত মুণ্ড, উপরের বাম হাতে খড়গ। ডানদিকের উপরের হাত অভয় মুদ্রায় এবং নিচের হাত বরমুদ্রা ধারণ করে  আছেন। মায়ের  গায়ের রং কালো মেঘের প্রভার মত  শ্যামা। তিনি দিগম্বরী অর্থাৎ বস্ত্রহীনা।  উনার গলার মুন্ডমালা গুলো থেকে বের হওয়া রক্ত উনার দেহ কে  রঞ্জিত করছে,  দুটি শবশিশু তার কর্ণভূষণ হওয়াতে দেবীকে ভয়ঙ্করী দেখাচ্ছে। তিনি তাঁর দাঁত দিয়ে নিজের জিহ্বাকে কামড় দিয়ে আছেন, তিনি কোমরে বেঁধে রেখেছেন হাতের মালা। তাঁর মুখে  মৃদুহাসি এবং উনার মুখ থেকে রক্তের ধারা বের হচ্ছে আর উনার মুখে অনন্ত কোটি সূর্যের তেজ বিদ্যমান। তিনি অতিশয় ক্রোদ্ধা, ভয়ংকর নাদকারিণী, উনার তিনটি চোখ আর সেই সকালের সূর্যের মত লালপ্রভাময়। উনার চারদিকে  চিৎকার করছে  শিয়ালের দল। আমি সেই দেবীর ধ্যান করি যিনি শবরুপ মহাদেবের হৃদয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। যার মুখ সুখ-প্রসন্নতায় ভরা। যিনি মোক্ষদায়িনী  এবং সকল ইচ্ছাপূরণকারিণী।

দেবীর অঙ্গের তাৎপর্যঃ


দেবীর মাথায় অর্দ্ধচন্দ্র তাঁহার মোক্ষ-প্রদান শক্তির পরিচায়ক।তাহা হইতে নিঃসৃত অমৃত সাধক কে  অমৃতত্ব বাঁ মোক্ষ প্রদান করিয়া থাকে। দেবী  মুক্তকেশী। তাঁর মুক্তকেশ চির-বৈরাগ্যের প্রতীক। জ্ঞান-অসির আঘাতে তিনি অক্টপাশ ছেদনকারী মা চির বৈরাগ্যময়ী। তাই তাঁর কালো চুল বিস্তৃত।

দেবীর তিন চোখ তিনটি আলোর প্রতীক, চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি। অন্ধকার বিধ্বংসী তিন শক্তির প্রকাশ। অজ্ঞতা, চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার থেকে মুক্ত করে। তিনটি চোখে দেবী অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে প্রত্যক্ষ করেন। কারণ,এই শক্তিই হল সৃষ্টি স্থিতি ও প্রলয়ের কর্তা।  দেবীর কানে দুতি বালকের শব যার অর্থ নির্ব্বিকার, নিস্কাম,শিশু্ভাবাপন্ন সাধক মায়ের অতি প্রিয়। দেবী রক্তবর্ণের জিহ্বাকে সাদা দাঁত দিয়ে কামড়ে রেখেছেন। লাল রং  রজোগুণের প্রতীক, সাদা রং সত্ত্বগুণের প্রতীক। সাদা দাঁত দিয়ে লাল জিহবাকে চেপে রাখা। অর্থাৎ সত্ত্বগুণর দ্বারা রজোগুণকে দমন করে রাখা। রজোগুণ ভোগের গুন, ঈশ্বর বিমুখ করে। রজোগুণ দমনের জন্য এই প্রতীক। অনেক সময় আমরা কোন অন্যায় বা মিথ্যাচার করলে জিহ্বার কামড় দেই অর্থাৎ অন্যায় করার স্বীকৃতি।

দেবীর গলায় পঞ্চাশটি মুন্ড দিয়ে মালা পরানো। পঞ্চাশটি মুন্ড পঞ্চাশটি অক্ষরের প্রতীক। ১৪ টি স্বরবর্ণ এবং ৩৬ টি ব্যঞ্জনবর্ণ, অক্ষর ব্রহ্ম, যার ক্ষয় নেই, শব্দ ব্রহ্ম, অক্ষরের দ্বারাই শব্দের উৎপত্তি হয়। এর অবস্থান মস্তকে। আমরা  মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা দেব বা দেবীর বন্দনা করি। এই মন্ত্রের অবস্থান মাথার  তালুতে সহস্রার পদ্মের মধ্যে। তাই অক্ষরের প্রতীক মুন্ড তাঁর গলায় হাত কর্মের প্রতীক। আমাদের সকল কর্মের ফলদাতা  তিনি। সকাম ভক্ত যারা তারা অতৃপ্ত কামনা নিয়ে দেহত্যাগ করে বলে পুনরায় মাতৃ জঠরস্থ হয়, হস্ত মেখলা প্রতীকে সকাম ভক্তের পুণর্জন্ম লাভ করার তত্ত্ব নিহিত।

দেবীর চাইতে বড়তো কিছুই নেই। তাই তিনি কি পরিধান করবেন? বিশ্বব্যাপী শক্তির অবস্থান। শক্তিকে আবরিত করা যায়না। তিনি স্বয়ং প্রকাশ। তাই দেবী উলঙ্গ।দেবী কখন দক্ষিণ পদ কখন বাম্পদ, অগ্রে স্থাপন করেন ইহার অর্থ এক পদে অতীতকে অন্যপদে ভবিষ্যত কে অধিকার করিয়া আছেন।

কালো রং সকল বর্ণের অনুপস্থিত। তাই কালো। কখনো বা তিনি শ্যমা- শ্যামবর্ণা। কালো রং ভয়ের উদ্রেক করলেও শ্যাম রং কোমলতা জাগায়। স্নিগ্ধতা ও কমনীয়তা জাগায়। তাই মাতৃসাধক কালী শ্যামবর্ণা রূপেও দর্শন করেছেন।

মা কালী শবরূপী শিবের বুকে দন্ডায়মানা। শিব স্থির, কালী গতিময়ী। গতি ঠিক রাখতে হলে স্থিরের উপর তার প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। শিব শুভ্রবর্ণ, কালী কালো বর্ণ। সাধক কূটস্থ দর্শন কালে এই শুভ্র রং বেষ্ঠিত কালো রং সাধনায় দেখে থাকেন।

কালীর রূপকল্পনাঃ-

মহাকালী, দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, গুহ্যকালী ও রক্ষাকালী প্রভৃতি নাম অনুসারে কালীমূৰ্ত্তির বিবিধ ভেদ আছে। ইনিই মূল প্রকৃতি; স্বল্পবুদ্ধি ও দুৰ্ব্বল মানুষের উপাসনা কার্য্যে সুবিধা করবার জন্যই তন্ত্রা আদিশাস্ত্রে এই প্রকৃতির কালী, তারা প্রভৃতি নাম ও রূপ কল্পিত হয়েছে। মহানিৰ্ব্বাণতন্ত্রেও এভাবে লেখা আছে-

“উপাসকানাং কার্য্যায় পুরৈব কথিতং প্রিয়ে।

গুণক্রিয়ানুসারেণ রূপং দেব্যাঃ প্রকল্পিতম্ ॥


(মহানিৰ্ব্বাণ ১৩ উল্লাস।)


উপাসকদের কার্য্যের সুবিধার জন্যই গুণক্রিয়া অনুসারে দেবীর রূপ কল্পিত হয়েছে।


আদ্যশক্তির প্রধান মূৰ্ত্তি কালী। শাক্ত উপাসকের মধ্যে প্রায় দশআনা লোক এই মূৰ্ত্তির উপাসক। ভগবতীর যতগুলি মূৰ্ত্তি আছে, তারমধ্যে দুর্গা ও কালীমূৰ্ত্তির বছল প্রচার। এই মূর্ত্তির কল্পনা কতকাল পূর্ব্ব হতে চলে আসছে, তা সহজে নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিত ও সেই মতাবলম্বী প্রাচ্য পণ্ডিতরা বলেন, এই মূৰ্ত্তি হিন্দুদের মৌলিক মূৰ্ত্তি নয়, ভারতের আদিম অধিবাসী অনাৰ্য্যদের দেবদেবী হতে সংগৃহীত হয়েছে। এরূপ মীমাংসা বা কল্পনায় কোন ফল আছে কি না তাহা বুঝা যায় না; কারণ, অনেক অনেক প্রাচীন পুরাণে ভগবতীর এই মূৰ্ত্তির কথা পাওয়া যায়। তবে এই পৰ্য্যন্ত স্বীকার করতে হবে যে, তান্ত্রিক যুগেই এই মূৰ্ত্তির উপাসনার নানাবিধ বিধি-নিয়ম সঙ্কলিত ও বহুল প্রচার হয়েছে।


তন্ত্রের কথা ছেড়ে আগে দেখা যাক, পুরাণ আদিতে ভগবতীর কালীমূর্ত্তির উৎপত্তি, পূজা, ধ্যান ইত্যাদি সম্বন্ধে কি কি বিবরণ পাওয়া যায়।


পুরাণের মধ্যে মার্কণ্ডেয় পুরাণখানি অপেক্ষাকৃত প্রাচীন বলে গণ্য। দেবীমাহাত্ম্য চণ্ডী-যা পাঠ বা শ্রবণ করলে ইন্দ্রের ঐশ্বৰ্য্যতুল্য ঐশ্বৰ্য্য ভোগ হয়—সেই চণ্ডীই এই পুরাণের অন্তর্গত। কালিকামূৰ্ত্তির উৎপত্তির কথা চণ্ডীতে দুই স্থানে কথিত হয়েছে। প্রখম,-মহিষাসুর বধের পর যখন দেবতারা শুম্ভ নিশুম্ভের অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়ে দেবীর স্তব করেছিলেন, সে সময়ে ভগবতী জাহ্নবীজলে স্নান করতে যাওয়ার ছলে, তাঁদের নিকট গিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, তোমরা এখানে কেন ? দেবতারা এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই ভগবতীর শরীর থেকে শিবা অম্বিকা নির্গত হয়ে বললেন,-দৈত্যপত্তি শুম্ভকর্ত্তৃক নিরাকৃত ও তার ভাই নিশুম্ভ কর্তৃক পরাজিত এই দেবতারা একত্র হয়ে আমার স্তব করছে। অম্বিকা ভগবিতীর শরীর-কোষ হতে উৎপন্ন হয়েছেন বলে তিনি কৌষিকী নামে বিখ্যাত হলেন ও হিমাচল আশ্রয় করে রয়েছেন। কৌষিকীর উৎপত্তির পর ভগবতীও নিজ গৌরবর্ণ ত্যাগ করে কৃষ্ণবর্ণ হয়েছিলেন বলে তিনি ‘কালিকা’ নামে বিখ্যাত হলেন এবং তিনিও হিমাচল আশ্রয় করে অবস্থান করতে লাগলেন; এই কালিকার রূপ কি, তা এস্থানে চণ্ডীতে উল্লেখ নেই। তারপরে চণ্ডীতে দ্বিতীয়স্থানে যে কালীমূর্ত্তির কথা আছে, তা এই;- কৌষিকীর হুঙ্কারে শুম্ভের সেনাপতি ধূম্রলোচন ভস্মীভূত হলে, শুম্ভ চগুমুগু নামক দুই প্রচণ্ড সেনাপতিকে বহুসৈন্য সহ কৌষিকীকে আনবার জন্য আদেশ দিলেন। চণ্ডমুণ্ড সৈন্যবল-পরিবৃত হয়ে মহাদৰ্পে দেবীর নিকট হিমাচলে উপস্থিত হলেন। দেবী তাদের দর্প দেখে সামন্য হাসলেন মাত্র। চণ্ডমুণ্ড এসে দেবীকে ধরতে অগ্রসর হল। দৈত্যদ্বয় নিকটে আসামাত্র দেবী মহাক্রোধে তাদের প্রতি তাকালেন। ক্রোধে তাহার মুখমণ্ডল কৃষ্ণবর্ণ হয়ে উঠল এবং তাঁহার ভ্রুকুটি-কুটিল ললাট হতে অতি শীঘ্ৰ এক দেবী নির্গত হয়ে, অসুরদেরকে প্রহার করতে লাগলেন। এই দেবীই কালী। এর রূপ এভাবে চণ্ডীতে উল্লেখ আছে-


“কালী করাল-বদনা বিনিষ্ক্রান্তাসিপাশিনী।

বিচিত্রখট্বাঙ্গধরা নরমালাবিভূষণা ॥

দ্বীপিচর্মপরীধানা শুষ্কমাংসাতিভৈরবা।

অতিবিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণা।

নিমগ্নারক্তনয়না নাদাপূরিতদিঙ্মুখা ॥

কালী, করালবদনা (লম্বিত-মুণ্ড-হস্তা), অসিপাশধারিণী, বিচিত্র থট্বাঙ্গধরা, নরমুণ্ডমালা শোভিতা, ব্যাঘ্ৰ চৰ্ম্ম পরিধানা, শুষ্কমাংসা, অতি ভয়ানক মূৰ্ত্তি, অতি বিস্তৃতমুখমণ্ডল, লোলরসনা, ভীষণা, গাঢ়-রক্তনয়না, হুঙ্কার শব্দে দিগ্মণ্ডল পরিপূর্ণকারিণী। এই কালী যুদ্ধে চণ্ডমুণ্ডকে বিনাশ করে, কৌষিকীর নিকট তাঁদের মুণ্ড দুইটি উপহার দিয়ে বললেন,- আমি চণ্ডমুণ্ড নামক মহাপশু দুটিকে হনন করে এনেছি, এখন যুদ্ধযজ্ঞে শুম্ভ নিশুম্ভকে তুমি নিজে সংহার কর। কৌষিকী হেসে কালীকে বললেন,-চণ্ডমুণ্ডকে বধ করেছ, তারজন্য তোমার নাম চামুণ্ডা বলে বিখ্যাত হবে।

সচরাচর যে কালী বা শ্যামা-মূৰ্ত্তি দেখা যায় তার সাথে এই মূৰ্ত্তির সম্পূর্ণ ঐক্য নেই, কিছুটা সাদৃশ্য আছে।

রক্তবীজবধের সময়ে এই কালী জিহ্বা বিস্তার করে রক্তবীজের শরীর থেকে নির্গত সমস্ত রক্ত ধারণ করে পান করেছিলেন। কৌষিকীর অস্ত্রপ্রহারে রক্তবীজ বিনষ্ট হয়।

চণ্ডীতেও কালীপূজার কোন বিধান নেই। শুম্ভ নিশুম্ভবধের পর দেবী দেবতাদের কে যে পূজাপদ্ধতি বলেছেন; তা শারদীয় মহাপূজার কথা।

দেবীভাগবতের ৫ম স্বন্ধে ২৩শ অধ্যায়ে কৌষিকী উৎপত্তির পর পাৰ্ব্বতীর শরীর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে কালিকা নামে প্রসিদ্ধ হওয়ার কথা আছে; কিন্তু এই কালিকার নাম কালরাত্রি বলেই কথিত হয়। চণ্ডীতে বলা এই কালিকার কোন কার্য্য পাওয়া যায় না, কিন্তু দেবীভাগবতে এর সাথে ধূম্রলোচনের ঘোর সংগ্রাম ঘটেছিল এমন বর্ণন হইয়াছে ও যুদ্ধের পরে এরই হুঙ্কারে ধূম্রলোচন বিনষ্ট হয়। ইনি বরাবর কৌষিকীর পাশে উপস্থিত ছিলেন। দেবীভাগবতেও চণ্ডমুণ্ড বধের সময় কৌষিকীর কপাল হতে ব্যাঘ্ৰচৰ্ম্মাম্বরা, ক্ররা, গজচৰ্ম্মোত্তরীয়া, মুণ্ডমালাধরা, ঘোরা, শুস্কবাপীসমোদরা, খড়গপাশধরা, অতি ভীষণা, খট্ট্বাঙ্গধারিণী, বিস্তীর্ণ-বদন, লোলজিহ্বা কালীর উৎপত্তি কথা আছে। এই কালী চামুণ্ডা নামে বিখ্যাত হন। ইনিই রক্তবীজের রুধিরপায়িনী। এছাড়া অন্যান্য পুরাণেও কালী, ভদ্রকালী, মহাকালী ইত্যাদি নাম পাওয়া যায়, কিন্তু উৎপত্তি সম্বন্ধে বিশেষ কোন বিবরণ পাওয়া যায় না।

কালীমূর্ত্তীর রূপক ভেদ করলে বুঝা যায়, ইহা সৰ্ব্ববিধ্বংসী মহাকালের প্রণয়িনী-অনন্তকালরূপী শিব পদতলে দলিত হয়েছেন, সৰ্ব্বধ্বংসকারিণী শক্তিজ্ঞাপক অসি হন্তে; ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালবাচক ত্রিনয়ন ইত্যাদি।

এস্থানে যতগুলি কালীমূৰ্ত্তির কথা দেওয়া হল, তার কোনটাই শিবারূঢ়া নহে, শবাসনার কথা ‘শ্যামা’ শব্দে দ্রষ্টব্য।


শক্তি পূজায় যে পঞ্চমকার যথা- মদ্য-মাংস-মৎস্য-মুদ্রা-মৈথুন এর কথা পাই তার অর্থ লোকনাথ বসু তাঁর হিন্দুধর্ম মর্ম গ্রন্থে লিখেছেন, পঞ্চ ম কারের প্রথমটি অর্থাৎ মদ কেবল এক পানীয় নয়। তা আসলে ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে ক্ষরিত অমৃতধারা বা সাক্ষাৎ আনন্দ। তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে খুলে যায় মস্তিষ্কের উপরিতল বা ব্রহ্মরন্ধ্র। তখন যে আনন্দধারা প্রবহমান হয়, তাই আসলে মদ্য বা কারণ! আবার সাধকজীবন ও দশমহাবিদ্যা গ্রন্থে তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীর মত, ‘মা মা’ বলতে বলতে যখন ভক্তি নেশার মতো থিতু হবে অন্তরে, তখন সেই মাদকতাকেই বলতে হবে মদ্য!


কালিকা উপনিষদও মদ্য বা কারণবারির এই অন্তর্নিহিত অর্থের দিকেই জোর দিয়েছে। তার নবম শ্লোকে বলা হয়েছে, পঞ্চমকারের বেদসম্মত আধ্যাত্মিক অর্থ বুঝে যিনি দেবীরর পূজা করবেন, তিনিই সতত ভজনশীল, তিনিই ভক্ত। তাঁর প্রচ্ছন্নতা দূর হয়ে মহত্ব প্রকাশিত হয়। তিনি নিরবিচ্ছিন্ন সুখ শান্তি লাভ করে সংসারপাশ থেকে চিরমুক্ত হন। সিদ্ধমন্ত্রজপকারী সাধকের অনিমাদি অষ্টসিদ্ধি লাভ হয়। তিনি জীবন্মুক্ত, সর্বশাস্ত্রবিদ হন। তাঁর হিংসাবৃত্তি বিনষ্ট হওয়ায় তিনি সকল জীবের বিশ্বাসভাজন হন।


কিন্তু, সাধারণ মানুষ মদ্যের এই গূঢ় অর্থ ভুলেছে। বঙ্গে তন্ত্রমতে কালী উপাসনা জনপ্রিয় হওয়ায় একসময় পঞ্চ ম কার-কে কেবল বহিরঙ্গেই ব্যবহার করতে থাকে সুবিধাবাদী শাসকশ্রেণি। সে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের সময়ের কথা। তখন মদ মানে উল্লাস, মাংসে-মৎস্যে ভোজন, মুদ্রা মানে যৌনসুখের আসন এবং মৈথুন বলপূর্বক শরীরসম্ভোগ! শান্ত বাঙালি চৈতন্যদেবের প্রভাবে এবং ইংরেজ শাসনের নৈতিকতার জেরে যৌনাচারের দিকটি পরে এড়িয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু জিভে লেগে রইল মাংস আর মৎস্যের স্বাদ। আর, মাথায় রইল মদের আচ্ছন্নতা। প্রতি বছর কালীপুজোর রাতে যা তুঙ্গে ওঠে। ঠিক বাল্মীকি প্রতিভার ডাকাতরা যা বলেছে- “আজ রাতে ধুম হবে ভারি, নিয়ে আয় কারণ বারি, জ্বেলে দে মশালগুলো, মনের মতন পুজো দেব- নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে!”


কিন্তু, মা কি ভক্তের এই বিস্মৃতিতে আদৌ প্রসন্ন হন?


তথ্যসূত্র- বিশ্বকোষ চতুর্থ খন্ড, দেবদেবীতত্ত্ব সহ পুরাণ ও উপনিষদ।

Saturday, October 30, 2021

27>|| ঈশ্বরের সঙ্গে একলা থাক ||

27>|| ঈশ্বরের সঙ্গে একলা থাক ||

               স্বামী যতীশ্বরানন্দ

সাধুসঙ্গের সুযোগ না হলে কি করা যাবে?"

★ইষ্ট দেবতার, তাঁর শুদ্ধ সাকার রূপের ধ‍্যান কর, তাঁরই সঙ্গ কর। ইষ্টের সঙ্গে কথা বলতে শেখ।"

★যখনই তুমি সাধুসঙ্গের প্রয়োজন বোধ করবে ঈশ্বরের চিন্তা কর; তাঁর নাম জপ কর। তিনিই আমাদের পেছনে সর্বশক্তির ধারক হয়ে রয়েছেন, তাঁকে বাদ দিলে আমাদের কোন অস্তিত্বই থাকে না। তিনি আমাদের আত্মার আত্মা। এই অন্তরাত্মার সঙ্গে সংযোগসাধনের চেষ্টা কর।

★একলা থাকার এক সহজাত ভীতি সকলের মধ্যেই যেন আছে বলে মনে হয়। কোন রকম একটা সঙ্গী তাদের সর্বদা দরকার। 

★কিন্তু যারা অন্তর থেকে নিজ ব‍্যক্তিত্বকে একটি পূর্ণ রূপ দিতে সমর্থ হয়েছে তাদের আর বাহ‍্য অবলম্বনের প্রয়োজন হয় না।

★একলাই শান্তিতে থাক। কেবল একলা থাকলেই তুমি ভগবৎ সঙ্গ আরো স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারবে। ঈশ্বরের সঙ্গে একলা থাক। অন্তরের দেবতার সঙ্গই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট।"

             ------ স্বামী যতীশ্বরানন্দ ------

*** জয়তু শ্রীরামকৃষ্ণ জয় মা জগৎজনণী জয় স্বামীজি মহারাজ ।লহ প্রনাম ।শুভ রাত্রি ।ভালো থাকবেন সকলে ।।***

                (সংগ্রহীত)

                 আদ্যনাথ

=====================

Wednesday, October 27, 2021

26 >|| ফলের প্রাপ্তি=জপ-ধ্যান করে

 26>|| ফলের প্রাপ্তি=জপ-ধ্যান করে

অমৃতকথা কথামৃত থেকে।

অমৃতকথা স্বামী ভূতেশানন্দ

   প্রশ্নঃ   জপ-ধ্যান করে যদি তার ফল আমরা ভগবানকে অর্পণ করি , তাহলে আমাদের সেই ফলের প্রাপ্তি কি করে হবে মহারাজ ? 

      উত্তরঃ  হবে না । বিশ্বাস রাখতে হবে । ঠাকুরের গল্প -- লঙ্কা থেকে একজন সমুদ্রের উপর হেঁটে আসছে , বিভীষণ কাগজে কি লিখে দিয়েছেন--- তাই নিয়ে । বেশ আসছে , হঠাৎ মনে হলো এর ভিতরে কি লেখা আছে দেখি তো ! খুলে দেখে তাতে কেবল ' রাম ' নাম লেখা আছে । তার মনে হলো --- এই ! মনে একটু সন্দেহ হতেই ডুবে গেল ; যতক্ষণ বিশ্বাস ছিল সমুদ্রের উপর দিয়ে সে বেশ হেঁটে আসছিল ।

====================

যাত্রাওয়ালা ও সংসারে সাধনা — ঈশ্বরদর্শনের (আত্মদর্শনের) উপায়

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিদ্যা অভিনেতার প্রতি) — আত্মদর্শনের উপায় ব্যাকুলতা। কায়মনোবাক্যে তাঁকে পাবার চেষ্টা। যখন অনেক পিত্ত জমে তখন ন্যাবা লাগে; সকল জিনিস হলদে দেখায়। হলদে ছাড়া কোন রঙ দেখা যায় না।

“তোমাদের যাত্রাওয়ালাদের ভিতর যারা কেবল মেয়ে সাজে তাদের প্রকৃতি ভাব হয়ে যায়। মেয়েকে চিন্তা করে মেয়ের মতো হাবভাব সব হয়। সেইরূপ ঈশ্বরকে রাতদিন চিন্তা করলে তাঁরই সত্তা পেয়ে যায়।"

“মনকে যে রঙে ছোপাবে সেই রঙ হয়ে যায়। মন ধোপাঘরের কাপড়।”

বিদ্যা — তবে একবার ধোপাবাড়ি দিতে হবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হ্যাঁ, আগে চিত্তশুদ্ধি; তারপর মনকে যদি ঈশ্বরচিন্তাতে পেলে রাখ তবে সেই রঙই হবে। আবার যদি সংসার করা, যাত্রাওয়ালার কাজ করা — এতে ফেলে রাখো, তাহলে সেই রকমই হয়ে যাবে।

—ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত থেকে।

==========================

শ্রীমাসারদা দেবী র আহার প্রসঙ্গে মা আম বেশি মিষ্ট অপেক্ষা অম্লমধুর --- টক টক, মিষ্টি মিষ্টি----আমই বেশি ভালোবাসিতেন।

 তিনি বোম্বাইয়ের আলফানসো, পেয়ারাফুলি ও ছোট ল্যাংড়া আম ভালোবাসিতেন, তবে ভক্তির সহিত কেউ খুব টক আম দিলে পরম প্রিয় বোধে আহার করিতেন ।

শাকের মধ্যে ছোলা শাক, মূলোশাক, আমরুল শাক ভালোবাসিতেন।

ফুটকড়াই, মুড়ি, বেগুনি, ফুলুরি, ঝালবড়া, আলুরচপ এই সব তেলেভাজা জিনিস খুব পছন্দ করিতেন।

মুগের নাড়ু, ঝুরিভাজা ইত্যাদিও তাঁহার প্রিয় ছিল।

রাতাবি সন্দেশ এবং রাঙা আলুর রসপুলি পিঠও ভালোবাসিতেন।

কলাইএর পাতলা ডাল ও পোস্ত বড়াও মায়ের খুব প্রিয় ছিল।

পান খাইতেন ও গুল মা দাঁতে দিতেন ।

সূত্র শ্রীশ্রীমায়ের কথা

অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে শঙ্করপ্রাণবল্লভে ।

জ্ঞানবৈরাগ্যাসিদ্ধ্যর্থং ভিক্ষাং দেহি চ পার্বতী ।। 

জয় মা...

আমাদের মা ই স্বয়ং অন্নপূর্ণা

“এক জেলে রাত্রে এক বাগানে জাল ফেলে মাছ চুরি করছিল। গৃহস্থ জানতে পেরে, তাকে লোকজন দিয়ে ঘিরে ফেললে। মশাল-টশাল নিয়ে চোরকে খুঁজতে এল। এদিকে জেলেটা খানিকটা ছাই মেখে, একটা গাছতলায় সাধু হয়ে বসে আছে। ওরা অনেক খুঁজে দেখে, জেলে-টেলে কেউ নেই, কেবল গাছতলায় একটি সাধু ভস্মমাখা ধ্যানস্থ। পরদিন পাড়ায় খবর হল, একজন ভারী সাধু ওদের বাগানে এসেছে। এই যত লোক ফল ফুল সন্দেশ মিষ্টান্ন দিয়ে সাধুকে প্রণাম করতে এল। অনেক টাকা-পয়সাও সাধুর সামনে পড়তে লাগল। জেলেটা ভাবল কি অশ্চর্য! আমি সত্যকার সাধু নই, তবু আমার উপর লোকের এত ভক্তি। তবে সত্যকার সাধু হলে নিশ্চয়ই ভগবানকে পাব, সন্দেহ নাই।"

“কপট সাধনাতেই এতদূর চৈতন্য হল। সত্য সাধন হলে তো কথাই নাই। কোন্‌টা সৎ কোন্‌টা অসৎ বুঝতে পারবে। ঈশ্বরই সত্য, সংসার অনিত্য।”

একজন ভক্ত ভাবিতেছেন, সংসার অনিত্য? জেলেটা তো সংসারত্যাগ করে গেল। তবে যারা সংসারে আছে, তাদের কি হবে? তাদের কি ত্যাগ করতে হবে? শ্রীরামকৃষ্ণ অহেতুক কৃপাসিন্ধু — অমনি বলিতেছেন, “যদি কেরানিকে জেলে দেয়, সে জেল খাটে বটে, কিন্তু যখন জেল থেকে তাকে ছেড়ে দেয়, তখন সে কি রাস্তায় এসে ধেই ধেই করে নেচে বেড়াবে? সে আবার কেরানিগিরি জুটিয়ে লেয়, সেই আগেকার কাজই করে। গুরুর কৃপায় জ্ঞানলাভের পরেও সংসারে জীবনন্মুক্ত হয়ে থাকা যায়।”

এই বলিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সংসারী লোকদের অভয় দিলেন।

প্রকৃত ভক্ত হলে ভগবান  তাঁর  আচার রীতি   দেখেন না। তিনি দেখেন ভক্ত তাঁর জন্য কতটা ভাবেন! মনের ভক্তি, ব্যাকুলতাই হলো আসল-------   

দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার ঠাকুরকে খুব ভক্তি করতেন। তাই প্রায়শ দক্ষিনেশ্বর  আসতেন। একবার দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার  আদালতের নথিপত্র, দলিল ইত্যাদি সমেত দক্ষিনেশ্বরে ঠাকুরের  সাথে দেখা করতে এসে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। কারন এই বিষয় সম্পত্তির কালিমা লিপ্ত কাগজ তিনি  ঠাকুরের সামনে আনতে চান নি।  ঠাকুর কিন্তু  তাঁকে দেখতে পেয়ে ভেতরে ডেকে পাঠালেন। তিনি প্রবল আপত্তি জানলে বললেন----" তোমাদের ওতে দোষ  হবে না, তুমি ভেতরে এস।"

 আবার তিনি একদিন অশুচি বস্ত্রে হঠাত দক্ষিনেশ্বর   আসেন। সেদিন তিনি ঠিক করেন ঠাকুরকে স্পর্শ করবেন না। সেদিনও কিন্তু তাঁকে দেখে ঠাকুর বললেন ------"এস, আমার কাছে এসে বসো।"

   আবার একদিন তিনি ঠাকুরের জন্য  পরম যত্ন করে গরম মিহিদানা   নিয়ে আসছিলেন। এদিকে আসার সময় তাঁর পাশে অন্য ধর্মের , বড়ো বড়ো দাড়ি  ওয়ালা  এক ব্যক্তি বসেছিলেন। তিনি দেবেন্দ্রর  সাথে খুব গল্প করতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরে  দেবেন্দ্র লক্ষ্য করলেন তাঁর মুখ  থেকে সমানে  থু থু নির্গত হয়ে মিহিদানার প্যাকেটে পড়ছে। খুব মনটা খারাপ হয়ে গেল তাঁর। ঠাকুরের জন্য হাতে করে নিয়ে এলেন, আর তা অপবিত্র হয়ে গেল!  কি আর করবেন! এইসব সাত পাঁচ  ভাবতে লাগলেন।

   দক্ষিনেশ্বর  পৌঁছে তিনি প্যাকেটটি এক কোণে  রেখে দিলেন। এদিকে অবাক কান্ড! কিছুক্ষণ পরেই  ঠাকুরের খুব  খিদে পেয়ে উঠল। খাবারের খোঁজে তিনি নিজের ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই সেই প্যাকেটটি ঠাকুর দেখতে পেলেন। দেখেই প্যাকেট খুলে একেবারে বালকের মত  সেই গরম মিহিদানা পরম তৃপ্তি করে খেতে শুরু করলেন ।

 ধন্য ভক্তি দেবেন্দ্র বাবুর। তিনি কৃপা পেয়েছিলেন ঠাকুরের। তাই তো ঠাকুর কোনো  দোষ  ধরেন নি। প্রণাম নাও ঠাকুর। কৃপা কর সকলকে

==========================


      

25>|| পূজো , জপ , একাদশী নিয়ে মা কিছু উপদেশ

 

25>||পূজো , জপ , একাদশী নিয়ে  মা কিছু উপদেশ



পূজো , জপ , একাদশী নিয়ে  মা কিছু উপদেশ দিয়েছেন। কিছু না খেয়ে পূজো করার পক্ষপাতী মা একেবারেই ছিলেন না। কারন মা জানতেন খাবার খেলে তবেই শরীর শক্তি পাবে। তাতে পূজো জপ অনেক ভালো হবে। কোনকিছু  খাওয়া ত্যাগ  করতে ঠাকুর মা কেউই বলেন নি। ঠাকুরও বলতেন কিছু খেয়ে পূজো করবে। খালি পেটে থাকবে না। স্বামীজি বলতেন ----"খালি পেটে কখনো ধর্ম হয় না।"


" জনৈকা ভক্তমহিলা --- একাদশীতে ভাত খান শুনে মা তাঁকে বলছেন, "বৌমা তুমি সধবা মানুষ, একাদশীর দিন ভাত খাবে। উপবাস করবে না। মাছের তেলে মাথা ঠাণ্ডা থাকে, খাবে। খাওয়ার মধ্যে কিছু নেই মা। জিহ্বাকে কষ্ট দেবে না। যা খাওয়ার ইচ্ছে হয় তাঁকে নিবেদন করে খাবে।


 অনিবেদিত বস্তু খাবে না। প্রসাদ আর হরিতে কোন বিভেদ নেই জানবে। খেয়ে-দেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে ভগবানের নাম করবে। মায়ের কথা শুনে ভক্তমহিলাটি মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "সকালে উঠে আগে জপ করে নিয়ে তিনি তারপর কিছু খান।" মা তার উত্তরে বলছেন, "সকালে আগে কিছু খেয়ে জপ করা যায়, তাতে কোন দোষ নেই।


 সন্ধ্যেবেলাতেও সারাদিনের কাজের পরে মুখে কিছু দিয়ে জল খেয়ে জপ-ধ্যানে বসলে শরীরটা বেশ শীতল হয়ে যায়। " 


      জয় মা, জয় ঠাকুর, জয় স্বামীজি🙏

24>|| ধর্ম ও বিজ্ঞানের বিস্ময়কর তথ্য ||

 

  24>|| ধর্ম ও বিজ্ঞানের বিস্ময়কর তথ্য ||

আজকের বিষয়, কিছু বিস্ময়কর তথ্য,
যেখানে ধর্ম আর বিজ্ঞান পরস্পরের মেলবন্ধনে মিলেমিশে একাকার।

নিচের মন্দিরগুলির বিষয়ে একটু জানুন।

১। কেদারনাথ,--উত্তরাখন্ড।79.0669°
২। কালহস্তী,--অন্ধ্রপ্রদেশ।79.7037°
৩। একাম্বরনাথ,--কাঞ্চি।79.7036°
৪। থিরুবনমালী।--তামিলনাড়ু।79.0747°
৫। থিরুবনইকবাল- তামিল,,  78.7108°
৬। চিদাম্বরম নটরাজ--তামিল,,79.6954°
৭। রামেশ্বরম--তামিলনাড়ু। 79.3129°
৮। কালেশ্বরম,--তেলেঙ্গানা 79.9067°

কোন সম্পর্ক খুঁজে পেলেন কি ? কোন সম্পর্ক এদের মধ্যে আদৌ আছে কিনা, ধারনা করতে পারেন ? একটা সম্পর্ক হল এগুলো সবই শিব মন্দির। আর কোন সম্পর্ক এদের মধ্যে নেই ?

তাহলে আসুন দেখা যাক এসব মন্দিরের মধ্যে আর কোন সম্পর্ক আছে কিনা ! আশ্চর্যজনক ভাবে সত্যি এটাই যে, এই মন্দিরগুলি সবই একই ৭৯° দ্রাঘিমা রেখায় অবস্থিত।

বিস্ময়কর হল, কোন প্রকার স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, জিএসপি বা অনুরূপ কৌশল ছাড়াই তখনকার স্থপতিরা শত শত কিলোমিটার দূরবর্তী এতগুলো মন্দিরকে একই দ্রাঘিমারেখায় কিভাবে স্থাপন করেছিলেন !

প্রত্যেকটি মন্দিরের পৃথক দ্রাঘিমাংশের দিকে খেয়াল করুন -
১। কেদারনাথ: ৭৯.০৬৬৯°।
২। কলহস্তী: ৭৯.৭০৩৭°।
৩। একাম্বরনাথ: ৭৯.৭০৩৬°।
৪। তিরুবনমালী: ৭৯.০৭৪৭°।
৫। থিরুবনইকবাল: ৭৮.৭১০৮
৬। চিদাম্বরম নটরাজ: ৭৯.৬৯৫৪°।
৭। রামেশ্বরম: ৭৯.৩১২৯°।
৮। কালেশ্বরম: ৭৯.৯০৬৭°।

নিচের ছবিটি দেখুন। সবগুলো মন্দিরই একটি সরলরেখায় অবস্থিত। আশ্চর্যজনক হল, তখনকার স্থপতিরা কত উন্নত মানের প্রযুক্তির অনুশীলন করতেন, যা এই যুগেও আমাদের কাছে সহজবোধ্য নয়।

আরো আশ্চর্যজনক হল, এই সবগুলো মন্দিরই প্রকৃতির ৫টি চিরন্তনী বিষয়কে উপস্থাপন করে, যাদের একত্রে " পঞ্চতত্ব" বা "পঞ্চভূত" বলা হয়। এগুলো হল ভূ বা পৃথিবী, বারি বা জল, পাবক বা আগুন, পবন বা বায়ূ এবং ভূত বা স্থান বা মহাশূন্য। এই পাঁচটি বিষয় দ্বারা উপরের আটটির মধ্যে পাঁচটি শিব মন্দিরকে এইভাবে  উপস্থাপন করা হয়েছে যে -

১। তিরুবনমালী মন্দিরকে জল দ্বারা,
২। থিরুবনইকবাল মন্দিরকে অগ্নি দ্বারা,
৩। কলহস্তী মন্দিরকে বায়ূ দ্বারা,
৪। একাম্বরনাথ মন্দিরকে পৃথিবী দ্বারা এবং
৫। চিদাম্বরম মন্দিরকে মহাশূন্য দ্বারা উপস্থাপন করা হয়েছে। এই পাঁচটি মন্দির একত্রে বাস্তু, বিজ্ঞান এবং বেদ এর মহামিলনকে উপস্থাপন করে।

এই মন্দিরগুলোর মধ্যে আরো কিছু ভূতাত্ত্বিক বিশেষত্ব আছে। এই পাঁচটি মন্দির আসলে যোগ বিজ্ঞানের সাহায্যে পরস্পরের প্রতি এক বিশেষ ভৌগলিক অবস্থানে নির্মিত, যার সাথে বিজ্ঞান এবং মানবশরীরবৃত্তীয় বিষয়াদির সাথে সম্পর্ক রয়েছে।

এই মন্দিরগুলো আজ থেকে অন্তত চার হাজার বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিল। সে সময় এসব স্থানের অক্ষাংশ বা দ্রাঘিমাংশ মাপার মত কোন স্যাটেলাইট প্রযুক্তি বা জিপিএস ছিলনা। সেই সময়ে এতগুলি মন্দির এত নির্ভুলভাবে একটি সরলরেখায় কিভাবে স্থাপন করা হয়েছিল তা ঈশ্বরই জানেন।

এই সরলরেখাটিকে বলা হচ্ছে "শিবশক্তি অক্ষ রেখা"। এই রেখাটির ৮১.৩১১৯° পূর্ব অক্ষাংশে রেখে কৈলাশের সবগুলো শিব মন্দির নির্মিত হয়েছে। কেন তা ঈশ্বর জানেন।

মহাকালের সাথে শিবজ্যোতির্লিঙ্গম এর আরো বিশেষ কিছু সম্পর্ক রয়েছে ! সনাতন ধর্মে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার জন্য উজ্জয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। এই উজ্জয়ন থেকে বিভিন্ন জ্যোতির্লিঙ্গম সমূহের মধ্যবর্তী দূরত্বওগুলি দেখুন কতটা চমকপ্রদ -

উজ্জয়ন থেকে সোমনাথ ৭৭৭ কিলোমিটার।
উজ্জয়ন থেকে ওঙ্কারেশ্বর ১১১ কিলোমিটার।
উজ্জয়ন থেকে ভীমাশঙ্কর ৬৬৬ কিলোমিটার।
উজ্জয়ন থেকে কাশী বিশ্বনাথ ৯৯৯ কিলোমিটার।
উজ্জয়ন থেকে মল্লিকার্জুন ৯৯৯ কিলোমিটার।
উজ্জয়ন থেকে কেদারনাথ ৮৮৮ কিলোমিটার।
উজ্জয়ন থেকে ত্র্যম্বকেশ্বর ৫৫৫ কিলোমিটার।
উজ্জয়ন থেকে বৈজুনাথ ৯৯৯ কিলোমিটার।
উজ্জয়ন থেকে রামেশ্বরম ১৯৯৯ কিলোমিটার।
উজ্জয়ন থেকে নৌশেশ্বর ৫৫৫ কিলোমিটার।

সনাতন ধর্মতত্বে কোন কিছুই অপ্রয়োজনীয় ছিল না এবং বিনা কারনে কোন কিছুই করা হয়নি। অতীতে সনাতন ধর্মে উজ্জয়নকে বিবেচনা করা হত বিশ্বের (ভূ-গোলকের) কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। সেই হিসেবে এখানে প্রায় ২০৫০ বছর পূর্বে ভূ-তত্ব, সূর্য এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের সনাতন ধর্মীয় বিভিন্ন পরিমাপের জন্য হস্তচালিত কিছু যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে, আনুমানিক ১০০ বছর আগে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা যখন ভূ-গোলকের মাঝামাঝি একটি কাল্পনিক রেখা টানেন, তখনও এর কেন্দ্রীয় এলাকা ছিল ঐ উজ্জয়ন। বর্তমান সময়েও বিশ্বের অধিকাংশ বিজ্ঞানী সূর্য ও মহাকাশ নিয়ে গবেষণার কাজ করতে উজ্জয়নেই আসেন।
             (সংগ্রহীত)
      <----- আদ্যনাথ----->
=========================

Monday, October 25, 2021

23>|| শিব কে?;--++ইষ্টের ধ‍্যান

 23>শিব কে?;--+ইষ্টের ধ‍্যান ||

==================

1>শিব কে?;--

প্রথমে জানবো শিব শব্দের অর্থ , শিব শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে  কল্যাণকারী  বা  মঙ্গল।  ভগবান শিবের পাঁচটি মুখ রয়েছে , এই পাঁচ মুখ দিয়ে তিনি জগতের মঙ্গল করে থাকেন , তাই তিনি কল্যাণকারী বা শিব নামে পরিচিত। 


 পাঁচ মুখ যথাক্রমে বামদেব , কালাগ্নি , দক্ষিনেশ্বর , ঈশান এবং কল্যাণ সুন্দরম্। আবার কোথাও একে ঈশান , তৎপুরুষ , অঘোর , বামদেব এবং সদ্যোজাত নামেও উল্লেখিত হয়েছে। শিবের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে  চিত্তিশক্তি  যা সকল প্রকার বন্ধন থেকে মুক্ত। শিবের তৃতীয় অর্থ  সদাশিব। 


 ব্রহ্মের সাকার এবং সগুণ রুপকে বলা হয় সদাশিব । তিনি আনুমানিক সাত হাজার বছর পূর্বে অবতরিত হয়েছেন । পরব্রহ্মের নানা শক্তির নানা অভিব্যাক্তিকে বলা হয়েছে দেবতা কিন্তু শিব এইসব দেবতাদেরও দেবতা । তাই তার এক নাম  মহাদেব । যাকে পরব্রহ্ম বলা হয়েছে যিনি নিরাকার এবং নির্গুণ তিনিই ' শিব ' নামে বিখ্যাত । যা সৃষ্টির মূলতত্ত্ব তাই শিবতত্ত্ব । বিভিন্ন শাস্ত্রে একমাত্র শিবকেই ' ঈশ্বর ' রূপে মানা হয়েছে । ভগবান শিবই এই সম্পূর্ণ সৃষ্টির অনাদি দেব । যার মহিমা বেদ , পুরাণ , দর্শন , যোগ , তন্ত্র ইত্যাদি সাহিত্যে সর্বত্র বর্ণিত হয়েছে। 


 ভারতের জন মানস যতটুকু বৈষ্ণব ধর্মে প্রভাবিত তার থেকে অনেক বেশি প্রভাবিত শৈবধর্মে। ভগবান শিব যোগী , ভক্ত , তান্ত্রিক , বেদান্তি , কর্মকাণ্ডী , উপাসক এবং দার্শনিক সকলের কাছে পূজনীয়। তিনিই জ্ঞান , কর্ম এবং ভক্তির আদি দেবতা । তিনিই পরমপুরুষ পরমব্রহ্ম । শিব এবং শক্তি মিলেই ব্রহ্ম তাই শিবকে ' অর্দ্ধনারীশ্বর ' বলা হয় । 


 তার দক্ষিণ অঙ্গ শিব স্বরূপ এবং বাম অঙ্গ শক্তিরূপ । মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর শিবের স্তুতি করেছেন । মহাভারতের অনুশাসন পর্বে ( 15/11 ) লিখিত হয়েছে --- শিবের সমান দেব নেই , শিবের সমান গতি নেই , শিবের সমান দাতা নেই , শিবের সমান বীর নেই। 

আসলে শিব কে ? শিবের পরিচয় কি ? এর যথার্থ বর্ণনার শেষ নেই , এর আদি অন্ত নেই। 

 

ওঁ নমঃ শিবায়।

           আদ্যনাথ রায় চোধুরী।

========================


2>ইষ্টের ধ‍্যান করার নিয়ম::--   

                       স্বামী বলভদ্রানন্দ।


গুরুদেবের দেওয়া মহামন্ত্র জপ করার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে ইষ্টমূর্তির ধ‍্যান করুন।আমাদের ধ‍্যান করার পদ্ধতি যেটা রামকৃষ্ণ রামকৃষ্ণ মিশনে শেখানো হয় সর্বত্রই---সেই পদ্ধতিতে।


*পদ্ধতিটি হচ্ছে "আপনি যেদিকে মুখ করে বসে আছেন, ভাববেন আপনার গুরু ও ইষ্ট সেই দিকেই চেয়ে আছেন।"*


পকেটে ঠাকুরের ছবি রাখেন তো? সেই ছবিটি যদি হৃদয়ে রাখেন তাহলে দেখা যাচ্ছে আপনি যেদিকে মুখ করে বসে আছেন আপনারা হৃদয়ে ইষ্টের ছবিটির মুখও একই দিকে।

*"ঠাকুর বলেছেন হৃদয় ডঙ্কমারা জায়গা।* অতত্রব হৃদয়েই ধ‍্যান করতে হবে।


ইষ্ঠের ছবি আমরা সামনাসামনিই দেখতে অভ‍্যস্থ।

*ইষ্টের মুখ ও সাধকের মুখ একই দিকে---এই পদ্ধতিতে যেহেতু দেখতে আমরা অভ‍্যস্থ নই সেহেতু প্রথম প্রথম অসুবিধা হবে।নিত‍্য অভ‍্যাসের ফলে এই পদ্ধতিটি আয়ত্ব করা সম্ভব।*


কথা হচ্ছে আমরা এভাবে ভাববো কেন?আপনি যদি চোখ বন্ধ করে এই পদ্ধতিতে ইষ্টকে হৃদয়ে দেখার চেষ্টা করেন, তাহলে আপনাকে automatically শরীরের বাইরে গিয়ে দেখতে হবে।


*এই বাইরে গিয়ে ইষ্টকে ধ‍্যানে হৃদয়ে দেখার চেষ্টাটিতে যদি আপনি নিত‍্য অভ‍্যাসের ফলে প্রতিষ্ঠিত হন,তাহলে আপনার ধীরে ধীরে শরীর্ত বোধটি কেটে যাবে*।


*প্রকৃত পক্ষে আমি যে ব্রহ্ম এটা বুঝতে হবে ,অনুভব করতে হবে। কাজেই শরীরের বাইরে এ বোধটাকে নিয়ে যেতেই হবে।*

               ( সংগ্রহ)

        আদ্যনাথ রায় চৌধুরী।

=======================




Monday, October 18, 2021

22>||★★ঐতিহাসিক নিলাম* -

  


22>||★★ঐতিহাসিক নিলাম* - 

       -( সংগ্রহ )

১৯৪৪ সালের ২৬ শে জানুয়ারী, 

রেঙ্গুনের মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিং প্রাঙ্গনে নেতাজীর সম্মানে আয়োজিত হয়েছিল এক বিশেষ সভা বর্মায় এটি প্রথম জনসভা, গন্যমান্য ব্যক্তি থেকে সাধারণ মানুষের মিলনে সভা তখন জনসমুদ্র।  

নেতাজী নামের এমন জাদু !

সভার প্রথমে বর্মার অধিবাসীদের তরফ থেকে নেতাজীকে একটি মালা পরানো হয়। তারপর নেতাজী প্রায় দু ঘণ্টা বলে গেলেন  ..... ...কখন যে এতটা সময় কেটে গেছে কেউ টের পায়নি -- শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ।

এবার নেতাজী মালাখানি নিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে বল্লেন -- এই মালাখানি সমস্ত বর্মাবাসী মানুষের শুভেচ্ছার প্রতীক। এই হিসাবে এটি অমূল্য। কালে এটি শুকিয়ে হয়ে যাবে মূল্যহীন। তাই এই মুহূর্তে এর যথার্থ মূল্যায়নের জন্যে আমি এটি নিলাম করতে চাই। যে অর্থ পাওয়া যাবে তা দিয়ে রেঙ্গুনে খোলা হবে আজাদ হিন্দ সংগ্রহশালা।

সর্বপ্রথম আকুল কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল এক শিখ যুবক, হরগোবিন্দ সিং -- 'নেতাজী, ঐ মালা আমি কিনতে চাই, এক লাখ ডলার মূল্য দেব'।

স্থানীয় বিখ্যাত ব্যবসায়ী ব্রিজলাল হরগোবিন্দকে পিছনে ফেলে বলেন -- 'আমি চাই ঐ মালা,দাম দু লাখ ডলার' আর একজন হেঁকে ওঠেন -- আড়াই লাখ। ব্রিজলাল গলা চড়ান -- তিন লাখ ডলার --- 'তিন লাখ দশ হাজার ..... ....... ।

মালার মূল্য ক্রমশই উর্ধমুখী, হরগোবিন্দ  নাছোড়বান্দা চিৎকার করেন -- চার লাখ।

সভার জনতা হরগোবিন্দকে সমর্থন করে। ... ব্রিজলাল এসেছেন ব্যবসায়ী ও অহংকারী মন নিয়ে, তিনি এটাকে পরাজয় মনে করে বলেন --'তবে পাঁচলাখ এক হাজার ....

হরগোবিন্দ বুঝলেন তাঁর আশা পূর্ণ হবার নয়, প্রায় সর্বস্ব পণ করেও পারলেন না ঐ পরম সম্পদের মালিক হতে ..... ।


নিলাম চলতে থাকে দুই ধনকুবেরের মধ্যে, শেষে দাম উঠলো সাত লক্ষ ডলার .... দিয়েছেন ব্রিজলাল ...

ব্রিজলাল এগিয়ে চলেছেন সম্পদটি নিতে, নেতাজী আসছেন সমর্পন করতে ... ঠিক সেই মুহূর্তে আর্তকন্ঠে চিৎকার করে উঠলেন হরগোবিন্দ ----- 'নে---তা---জী' ......

জনতা বললে - নেতাজীকে ডেকে কি হবে..? ক্ষমতা থাকে তো দাম বাড়াও ...

হরগোবিন্দ বল্লে - তোমার সঙ্গে আমার কথা নেই, যা বলার নেতাজীকে বলব ...

নেতাজী বললেন -- বলো, কি বলতে চাও।

হরগোবিন্দর চোখে তখন জল আর আগুন --- 'ভিক্ষা করার ভঙ্গীতে বললেন ---- ------  "নেতাজী, সিঙ্গাপুরে আমার ক'খানা বাড়ী আছে, গ্যারাজে আটখানা ট্রাক আছে, তিনচার লক্ষ ডলার আছে, আরও হয়ত কিছু আছে --জানি না সব যোগ করলে সাত লক্ষ ডলার ছাড়িয়ে যাবে কিনা !!! তবে এই নিলামে আমার শেষ ডাক -- যেখানে আমার যা কিছু আছে,শেষ কপর্দক পর্যন্ত -- সব আমি আজাদ হিন্দ ফান্ডে লিখে দিচ্ছি,--- বিনিময়ে ঐ মালাখানি আমার চাই ----

হরগোবিন্দর দুচোখে বর্ষার ধারা .... দেহ কাঁপছে ....

নেতাজীর চোখে আনন্দ ... মঞ্চ থেকে নেমে এলেন, বুকে জড়িয়ে ধরলেন হরগোবিন্দকে .... মালাখানি পরিয়ে দিতে গেলে হরগোবিন্দ বললেন ...... "আপনার গলার মালা কি আমি গলায় পরতে পারি নেতাজী .... আমার মাথায় রাখুন" !!!

ব্রিজলাল ছাড়তে চান না তার অধিকার ... তাকে নেতাজী শান্ত করেন ,বলেন --- বহ তো নঙ্গা ফকির বন চুকা,ওর সঙ্গে তোমার আর লড়াই চলে না ভাই,টাকা দিয়ে ভিখিরিকে ডিঙোনো যায় না"

এবার হরগোবিন্দ একটি আর্জি পেশ করল --নেতাজী, আর একটি ভিক্ষা।  'বলো হরগোবিন্দ', আশ্বাস দিলেন নেতাজী....

হরগোবিন্দ বললেন -- "এখন গাছতলা ছাড়া আমার তো আর দাঁড়াবার স্থান রইল না , দিনে দু মুঠো গমও তো চাই জীবন ধারনের জন্য, তাই আপনি আমাকে আশ্রয় দিন, আজাদ হিন্দ ফৌজে ভর্তি করে নিন দয়া করে"।

অভিভূত নেতাজী বুকে টেনে নিলেন এই  সর্বস্ব ত্যাগী যুবককে।।

--- --- এমন দৃশ্য, এমন ইতিহাস আর কেউ কি কোন ও দিন গড়তে পারবে ?

-------জয় হিন্দ----- 🇮🇳

==========================

Sunday, October 17, 2021

21>||★★ 'মা'এর কোনো জাত ধর্মে নেই, থাকে না।

 


★★21>মা'এর কোনো জাত ধর্মে নেই, থাকে না।

                   স্বামী বিবেকানন্দ।

১৮৯৮ সাল!!

চিকাগো থেকে ফেরার পর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। স্বামীজী বসে আছেন বেলুড় মঠের গঙ্গার তীরে। শীতের বিকালের শেষ রোদ গঙ্গার ঢেউয়ের বিভঙ্গে লুকোচুরি খেলছে তখন। 

স্বামীজীর পাশেই বসে আছেন, তাঁর বিদেশীনী শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা। 

নৈস্বর্গীক নিস্তব্ধতা ভেঙে, জলদগম্ভীর কন্ঠে স্বামীজী বলে উঠলেনঃ - 

নাঃ সিস্টার!! এই ভাবে বসে বসে সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছেনা!!


সিস্টারঃ - বলুন স্বামীজী কি করতে হবে??

স্বামীজীঃ - সারা পৃথিবী কে আমি ভারতীয় দর্শন তো বোঝালাম। কিন্তু আমি নিজে কি আজও ভারত মা কে জানা চেনার চেষ্টা করেছি?? ভাবছি পায়ে হেঁটে আমি ভারত মা কে দর্শন করবো। তুমি কি পারবে আমার সঙ্গে যেতে??

সিস্টারঃ - এ তো আমার পরম সৌভাগ্য স্বামীজী!! এই দেশটাকে আমি আমার নিজের দেশ ভেবে সব ছেড়ে চলে এসেছি। এই দেশকে চেনা জানার সৌভাগ্য আমি অর্জন করতে চাই। যত কষ্টই হোক, আমি আপনার সঙ্গে যাব স্বামীজী!!

যেমন ভাবনা, তেমন কাজ!!

দক্ষিণের কন্যাকুমারী থেকে শুরু হলো পায়ে হেঁটে ভারত দর্শন। গন্তব্য উত্তরের কাশ্মীর উপত্যকা। 

টানা প্রায় ৬ মাস পথ চলে, অক্টোবরে স্বামীজী পৌঁছালেন কাশ্মীর। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর তখন প্রায় চলছেনা, একটু বিশ্রাম চাইছে। উপত্যকার একটা ফাঁকা মাঠের পাশে একটা পাথরের খন্ডের উপর বসে ক্ষণিক বিশ্রাম নিচ্ছেন স্বামীজী। সামনের মাঠে খেলা করছে কয়েকটি স্থানীয় শিশু কিশোর। 

একটি বছর পাঁচেকের শিশুকন্যাও তাদের মধ্যে রয়েছে। ঐ কন্যাটির দিকে একদৃষ্টে দেখছেন স্বামীজী। 

কন্যাটির মা, তাঁর মেয়েকে ডেকে, একটি পাত্র করে কিছু খাবার দিয়ে গেলেন। মেয়েটিও খাবারটি সবে মুখে তুলতে যাবে!!এমন সময়ে, আরও দূর থেকে, আরও ছোট একটি ছেলে চিৎকার করে নিজেদের ভাষায় কিছু একটা বলতে বলতে মেয়েটির কাছে ছুটে এলো। মেয়েটি নিজের মুখের খাবারটা রেখে দিলো আবার পাত্রের মধ্যে। খাবার সমেত পাত্রটি এগিয়ে দিলো ঐ ছেলেটির দিকে। 

স্বামীজীও উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন!! চিৎকার করে বললেন - সিস্টার আমি পেয়ে গেছি!!

সিস্টারঃ - কি পেলেন স্বামীজী??

স্বামীজীঃ - মা দূর্গাকে পেয়ে গেছি!! ভারত মা কে খুঁজে পেয়েছি!!

স্বামীজীঃ - ঐ দ্যাখো সিস্টার!! যে মেয়েটা নিজের মুখের খাবার, হাসতে হাসতে ভাইয়ের মুখে তুলে দিতে পারে, যুগ যুগ ধরে সেই তো আমার মা দূর্গা!! সেই তো আমার ভারত মাতা!!

স্বামীজীঃ - সিস্টার!! তুমি পূজার উপকরণ সাজিয়ে ফেল। আগামীকাল দূর্গাপূজার অষ্টমীতে এই মেয়েটিকেই আমি ক্ষির ভবানী মন্দিরে, দূর্গার আসনে বসিয়ে কুমারীপূজা করবো। আমি যাচ্ছি মেয়েটির বাবার সঙ্গে কথা বলতে। 

হঠাৎ স্বামীজীর রাস্তা আটকে দাঁড়ালেন কিছু কুসংষ্কারাচ্ছন্ন কাশ্মীরী পন্ডিত!!

স্বামীজী!! আপনি দাঁড়ান!!

পন্ডিতরাঃ - স্বামীজী!! আপনি না জেনে বুঝেই ভুল করতে যাচ্ছেন!! ঐ মেয়েটিকে আপনি কখনোই দূর্গা রূপে পূজা করতে পারেন না!! ওর জন্ম মুসলমান ঘরে!! ওর বাবা একজন মুসলমান শীকারা চালক!! ও মুসলমানের মেয়ে!!

স্বামীজীর কান দুটো লাল হয়ে গেছে!!

চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠেছে!!

গম্ভীর গলায় স্বামীজী বললেনঃ -

আপনারা আপনাদের মা দূর্গাকে হিন্দু আর মুসলমানের পোষাক দিয়ে চেনেন!! 

আমি আমার মা দূর্গাকে অন্তরাত্মা দিয়ে চিনি!!

ঐ মেয়েটির শরীরে হিন্দুর পোষাক থাক বা মুসলমানের পোষাক, ওই আমার মা দূর্গা!!

আগামীকাল ওকেই আমি দূর্গার আসনে বসিয়ে পূজা করবো!!


পরেরদিন সকাল!!

দূর্গাপূজার অষ্টমী!!

ক্ষির ভবানী মন্দিরে ঘন্টা বাজছে, শাঁখ বাজছে!!

মুসলমানের মেয়ে, বসে আছে দূর্গা সেজে!!

পূজা করছেন, হিন্দুর সন্তান স্বামী বিবেকানন্দ!!

পূজার উপকরণ সাজিয়ে দিচ্ছেন, খ্রীষ্টান ঘরে জন্ম নেওয়া ভগিনী নিবেদিতা!!


এই হলো মহামানবের দূর্গা পূজা। এই হলো মানবিকতার দূর্গা পূজা।

মা আমাদের সবার। জাত ধর্মে নির্বিশেষে সবার। মা র কোনো জাত ধর্মে নেই, থাকে না।

      ( সংগ্রহ)

=======================

Tuesday, September 7, 2021

20>||পঞ্চমুখী হনুমানের রহস্য----

   20>||পঞ্চমুখী হনুমানের রহস্য----


রামভক্ত হনুমানের পাঁচটি মুখ। বিপদতারণ হনুমানের এই পঞ্চমুখের পিছনে আছে রামায়ণের কাহিনীর মধ্যে একটি আকর্ষনীয় কাহিনী যা জড়িয়ে আছে রাম-রাবণের যুদ্ধের সঙ্গে।


রামের বিরুদ্ধে জয়ী হতে রাবণ সাহায্য চান মহীরাবণ এবং অভিরাবণের। তাঁরা দুজনেই ছিলেন লঙ্কারাজ রাবণের ভাই, পাতালের শাসক। মহীরাবণ রূপ ধারণ করেন বিভীষণের, আসেন রাম-লক্ষ্মণের কাছে। দুজনকে অপহরণ করে নিয়ে যান পাতালে। 


রাম-রামানুজকে খুঁজতে হনুমান যান পাতালে। গিয়ে দেখেন দ্বারে প্রহরায় আছেন মকরধ্বজ। এই মকরধ্বজের জন্ম নিয়েও আছে আরো এক কাহিনী। রামায়ণ অনুযায়ী মকরধ্বজের জন্মের পিছনে হনুমানের অবদান আছে।


স্বর্ণলঙ্কায় অগ্নিকাণ্ডের পরে লেজের আগুন নেভাতে হনুমান লেজ চুবিয়েছিলেন সমুদ্রের জলে। তখন তাঁর এক ফোঁটা ঘাম থেকে মকরধ্বজের জন্ম। তাই‚ মকরধ্বজ হনুমানকে নিজের পিতা ভাবতেন।


পাতালের প্রবেশপথে মকরধ্বজকে দেখে হনুমান নিজের পরিচয় তাঁকে দেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে প্রণাম করে পথ ছেড়ে দেন মকরধ্বজ।


হনুমান পাতালে প্রবেশ করে দেখেন মহীরাবণ এবং অভিরাবণকে বিনাশ করতে হলে পাঁচটি দীপ নেভাতে হবে। তাদের মুখ আবার পাঁচদিকে। তাই‚ হনুমান পাঁচটি মুখ ধারণ করলেন।


একটি মুখ হল বরাহ-মুখের মতো, সেই মুখটি থাকল উত্তরদিকে। নরসিংহের মতো দেখতে মুখ থাকল দক্ষিণ দিকে। গরুড়রূপী মুখ থাকল পশ্চিমে। হয়গ্রীবা মুখ হল আকাশমুখী। আর‚ হনুমানের নিজস্ব মুখ থাকল পূর্বমুখী হয়ে।


এই পঞ্চমুখ নিয়ে পাতালে প্রবেশ করে হনুমান পাঁচদিকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলেন পাঁচটি দীপ। তারপর বিনাশ হল মহীরাবণের। উদ্ধার পেলেন রাম-লক্ষ্মণ। রামচন্দ্রের নির্দেশে পাতালের শাসক হলেন মকরধ্বজ। তাঁকে দায়িত্ব অর্পণ করলেন হনুমান।


এইভাবে‚ রামচন্দ্রের সেবায় পঞ্চমুখের অধিকারী হন ভক্ত হনুমান।


 পবনপুত্র হনুমান কি জয়।

            জয় হনুমান 

                  ( সংগ্রহ)

Friday, August 6, 2021

19>ত্যাগ-তিতিক্ষা= নচিকেতার গল্প কথা)

  19>||ত্যাগ-তিতিক্ষা= নচিকেতার গল্প কথা)


অনেক দিন আগের কথা। সেকালে বাজশ্রবা নামে এক মুনি ছিলেন। 

মুনি ছিলেন পরম ধাৰ্মিক 

এবং যাগযজ্ঞপরায়ণ। 

তার এক ছিলো পুত্র —নাম নচিকেতা।

বাজশ্রবা মুনিএকদিন এক যজ্ঞ করলেন, 

সেই যজ্ঞে আমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের গোদান করলেন, উপহার-উপঢৌকনে ভরিয়ে দিলেন দরিদ্র ব্রাহ্মণদের। ছোট্ট ছেলে নচিকেতা, দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেন বাবা যে গোরুগুলো দান করলেন, সেগুলো মৃতবৎসা। সেগুলি কখনই

 দুধ দেবে না। আর উপহার সামগ্রীর বেশির ভাগ টাই অকাজের। বাবার এহেন ভ্রষ্টাচারে, লজ্জিত নচিকেতা বাবাকে  জিজ্ঞেসা করলেন “বাবা, তোমার এমন লোক-ঠকানো অকিঞ্চিৎকর দানের অর্থ”? ছোট মুখে বড় কথা, বাজশ্রবা চিৎকার করে বললেন ‘এবার তোমাকেও আমি যমের দক্ষিণ দুয়ারে পাঠাব’। সেটাই হবে আমার মহত্তম দান। মুখ থেকে কথা খসামাত্রই যমদূতেরা হাজির, তারা নচিকেতাকে জোড়করে  টেনে নিয়ে গেল যমরাজের দরবারে। 


এদিকে যমরাজ বিশেষ কাজে যম লোকের বাইরে। যমরাজ তিনদিন  বাদে ফিরে  ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর নচিকেতাকে এমন ভাবে দেখে তাকে নিয়ে আসার হেতু জানতে চাইলেন এবং মুগ্ধ হলেন ওইটুকু ছেলের ত্যাগ-তিতিক্ষায়। 

ফুটফুটে নচিকেতাকে কোলে বসিয়ে যমরাজ ভূরিভোজনের ব্যবস্থা করলেন,এবং নচিকেতাকে  তিনটি বর প্রদান করলেন। 

প্রথম বরে নচিকেতা তাঁর বাবার বুদ্ধি বিভ্রমের প্রতিকার চাইলেন। যমরাজ বললেন তথাস্তু। দ্বিতীয় বরে, যজ্ঞে মোক্ষলাভের গোপন বীজমন্ত্র শিখতে চাইলেন নচিকেতা। সেটিও মঞ্জুর হল। যমরাজ আরও বললেন, তিনবার এই যজ্ঞ সমাপনে নচিকেতাকে আর জন্ম মৃত্যুর পাকেচক্রে আবর্তিত হতে হবে না। পরম ব্রহ্মের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে নচিকেতার। আর যজ্ঞটিও পরিচিত হবে ‘নচিকেতা যজ্ঞ’ নামে। 

এবার তৃতীয় বরের পালা। নচিকেতা যমরাজের কাছে জানতে চাইলেন মৃত্যুর পর কী পরিণতি হয় মানুষের? গূঢ়, গোপনীয় তথ্য। যমরাজ বললেন, যে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবতারাও জানেন না, হে নচিকেতা তুমি তার নাগাল পাবে কীভাবে? নাছোড় নচিকেতা। মরণের পরের সংবাদ তাঁর চাইই চাই। ভুলিয়ে-ভালিয়ে যমরাজ বিশাল রাজ্য, পরমাসুন্দরী অপ্সরা, বিপুল বৈভব, ক্ষমতা আর ঐশ্বর্যের লোভ দেখালেন। খেয়ে পরে সুখে শান্তিতে দিনগুজরানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। নচিকেতা বললেন, সুখ শান্তি কতদিনের? যে মুহূর্তে আপনি ডাকবেন, পরনের সুতোটিও ছেড়ে আপনার শরণাগত হতে হবে। তাহলে বিত্ত-বৈভব-ইন্দ্রিয়সুখ তো ক্ষণিকের মায়া, মরীচিকা। অবশেষে যমরাজ বাধ্য হয়ে বললেন 

পথ দুটো: একটা ভোগের, 

               দ্বিতীয়টা ত্যাগের। 

প্রথম পথের শেষে স্বাগতম জানাবে মৃত্যু। 

দ্বিতীয়টি আত্মজ্ঞানের, 

উত্তরণ-উন্মোচন-আত্মোপলব্ধির, অমরত্বের। 

নচিকেতা দ্বিতীয় পথটিকেই বাছলেন। 

তখন যমরাজ তাঁকে রথের উপমা টেনে শরীর-মন-বুদ্ধি-অনুভূতি-জীবাত্মার স্বরূপ

বর্ননা করে বললেন--

“আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরংরথমেব তু।

/বুদ্ধিংতু সারথিং বিদ্ধি মনঃপ্রগ্রহমেব চ।।

/ ইন্দ্রিয়াণি হয়ানহুর্বিষয়াংস্তেষু গোচরান।

/আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্তং ভোক্তেত্যাহর্মনীষিণঃ” 

(কঠোপনিষদ ১।৩। ৩-৪)। 


অর্থাৎ আত্মা রথী, শরীর নামক রথে আরূঢ় তিনি। রথের সারথি বুদ্ধি। মন হল লাগাম। আর ঘোড়া পঞ্চেন্দ্রিয়। মন, বুদ্ধি স্থির থাকলে শরীর রথ নিবাত-নিষ্কম্প। সাফল্য করায়ত্ত। কিন্তু মন-বুদ্ধি-হৃদয় বিপথগামী হলেই শরীর নামক রথও বিগড়বে। রথে জোতা অশ্বের বিশৃঙ্খল আচরণে প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা বাড়ে সারথি বা রথীর! রথী জীবাত্মা, সারথি পরমাত্মা। ঘোড়ারা ক্ষ্যাপামি করলে, সারথির পক্ষে রথের ভারসাম্য বজায় রেখে সঠিকপথে রথের পরিচালন অসম্ভব হয়ে পড়ে। শরীর রথের অন্দরে, হৃদয়ে সমাসীন জীবাত্মা, মন-বুদ্ধি তাকে পথ দেখিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিয়ে দেবে। 

হৃদয়-মন-বুদ্ধির সামান্য বেচালে শরীর-রথ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পথভ্রষ্ট হয়। জন্ম-মৃত্যুর পঙ্কিল ঘূর্ণিপাকে কলুর বদলের মত নিশিদিন ঘুরপাক খেতে থাকে নশ্বর মনুষ্যজীবন। শোক-তাপ-জরা থেকে মেলে না মুক্তি। 


ষড়রিপু বা ইন্দ্রিয়কে চালনা করে মন, ইন্দ্রিয়ের থেকে বড় তাই মন, মনের থেকে বুদ্ধি। হৃদয়ের অন্তঃস্থলে আসীন আত্মা—‘পুরুষ’, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলে তবেই তার সঙ্গে মিলন হবে ‘প্রকৃতি’র। সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে অপার্থিব আলোর ঝলকানিতে সৃজিত হবেন পরমাত্মা, পরমব্রহ্ম। 


ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলছেন, ডাব নরম শাঁস আর জলে ভর্তি, জড় আর চেতন মিলেমিশে ঢ্যাবঢ্যাবে। ঝুনো নারকেল পরিপুষ্ট, পরিণত, খটখটে। খোসা থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। মনকে শক্ত হাতে লাগাম পরাতে পারলেই জাগতিক কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে, ঝুনো নারকেল, ব্রক্ষ্মের স্বরূপে উপনীত হওয়া সম্ভব। 


ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব  দিনের মধ্যে ৩৬ বার সমাধিস্থ হতেন, ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁর নাড়ির হদিশ পেতেন না। আশ্চর্য হয়ে তিনি স্বগতোক্তি করেছিলেন পরমহংস ৩৬ বার মরছে আবার বেঁচেও উঠছে, কোন জাদুবলে? সমাধিকালে আত্মাকে নারকোলের মত শরীর নামক খোসা থেকে ছাড়িয়ে নিয়েই নাড়ির স্পন্দন বিরহিত হতেন রামকৃষ্ণদেব।

  ‘জীবনমুক্তিঃ সুখমপ্রাপ্তিঃ’। 


চিকিৎসাশাস্ত্রে যার ব্যাখ্যা ডাঃ সরকার খুঁজে পাননি। সাধনমার্গের সাধকদের পক্ষেই এ মায়ার খেলা সম্ভব। 


রথযাত্রা আসলে সফর/পথচলা। 

ব্রক্ষ্মের সঙ্গে মিলনের বাহন রথ। 


দক্ষিণ ভারতের রথোৎসবে তাই সাড়ম্বরে পালিত হয় ‘ব্রহ্মোৎসব’। 

কিন্তু পুরীর রথে ব্রহ্মোৎসব অনুপস্থিত। মানুষের শরীর-রূপী রথে মোক্ষলাভের সমস্ত উপকরণই মজুত। 



রথে আসীন শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব মানুষের মধ্যে নেমে এসে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন কীভাবে যাত্রার শেষে অভীষ্ট মোক্ষের পথে পৌঁছতে হবে! 

তাই পুরীর রথযাত্রায় নেই কোনও ভেদাভেদ। নেই উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধনের বিচার। মোক্ষের পথ, ধর্মাধর্ম ভেদে আলাদা হতে পারে না। 

গজপতি রাজাকেও, আত্মসম্মার্জনার পথে, পুরীর রথে ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে হয়। 

ভিন্নধর্মী আলেকজান্ডার ক্যানিংহ্যাম বা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর শ্রীমন্দিরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, পুরীর রথে স্বাগতম সকলেই। 

সতেরশো শতাব্দীর ঘটনা। জাহাঙ্গিরের সুবেদার, ভক্ত কবি  ‘সালাবেগ’ রথ-দর্শনে পরিত্রাহি ছোটার সময় পড়ে গিয়ে জখম হলেন। প্রভুর কাছে করুণ মিনতিতে বললেন দয়াপরবশ হয়ে প্রভু একটু যদি ‘সালাবেগের’ জন্য অপেক্ষা করেন। কী স্পর্ধিত আবদার! বড়া ডান্ডা অর্থাৎ মন্দিরের সামনের গ্র্যান্ড রোডে জগন্নাথদেবের ১৬ চাকার রথ ‘নন্দিঘোষ’ গেল আটকে, সারথির প্রাণপণ চেষ্টাতেও নড়ল না স্থাণুবৎ রথ। 

আজও ‘বড়া ডান্ডায়’ রথের দিন সাময়িক আটকে থাকে রথ। ভিন্ন ধর্মের মানুষদের দর্শনাকাঙ্ক্ষা পূরণে সিংহদ্বারে জগৎপিতা সব ধর্মের মানুষকে পতিতপাবন-রূপে দিবারাত্র দর্শন দেন। ‘ব্রহ্মোৎসব’ পুরীর রথ লোকাচারে বেমানান, তাই বাতিল।  

মানবশরীর যেমন পঞ্চভূতে গড়া, তার সমাপ্তিও তেমন পঞ্চভূতে বিলীন। শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীজগন্নাথদেবের রথও তেমন পঞ্চ উপাদানে তৈরি, কাঠ-ধাতু-রঙ-কাপড়-জরি। 

মন ও বুদ্ধি বা চেতনার যথোপযুক্ত প্রদর্শনে পুরীর রথে সারথি অর্জুন, 

আর মহাভারতের যুদ্ধে রথের রশি শ্রীকৃষ্ণের হাতে, রথী অর্জুন। 

মন, সাধারণ মানুষের বুদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে, বুদ্ধি মনকে নিয়ন্ত্রণ করলেই সাধনমার্গের দরজা খুলে যায়। 


মানসিক চাপ হৃদপিণ্ডের ক্ষতি করে, ধমনীতে চর্বি জমে, রক্তপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হার্ট অ্যাটাকের সূচনা হয়। ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধলে, মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ বাঁধা পায় ফলে অবশ্যম্ভাবী হয় ব্রেন স্ট্রোক। 

মন-হৃদয়-মস্তিষ্ক একতারে বাঁধা। রথের রশি-অশ্ব-সারথির সন্ময় যুগলবন্দিতে সামান্য তাল কাটলে রথও যেমন বেসামাল, মানবশরীরও তাই।

<--©➽-আদ্যনাথ রায় চৌধুরী--->

====================



Tuesday, August 3, 2021

18>||এক নারী চরিত্র গহরবানু, ||

 18>||এক নারী চরিত্র গহরবানু, ||


চম্বলের পুতলীবাঈ, যে নর্তকী হাতে নিয়েছিল বদলার রাইফে

মধ্যপ্রদেশের মোরেনা, ভিন্দ, শেহপুর ও গোয়ালিয়র, উত্তর প্রদেশের জালাউন, এটাওয়া, রাজস্থানের ঢোলপুর জেলাগুলি নিয়ে প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে আছে চম্বল উপত্যকা।
যার মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে ইতিহাসের চমনবতী নদী।
আজ যার নাম চম্বল।
ভারতের একমাত্র নদী যা দক্ষিণ দিকে না এসে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়েছে।
মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ঘুরে উত্তরপ্রদেশের কানপুরের কাছে যমুনায় মিশেছে এই চম্বল নদী।

চম্বল নদীর জলধারা হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন স্রোতে বিভিন্ন দিকে বয়ে, এলোমেলো ভাবে ভূমিক্ষয় ঘটিয়েছে। প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি করেছে করে ১০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু হাজার হাজার মাটির পাহাড়। পাহাড়গুলির গা বেয়ে নেমে এসেছে  সংকীর্ণ গিরিখাত।

প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে তৈরি হয়েছে মাটির গুহা, ফাটল, সুড়ঙ্গ।
লোকচক্ষু এড়িয়ে কোনও ফাটলের মধ্যে দিয়ে মাইলের পর মাইল চলে যাওয়া যায়।
 শক্ত কাদামাটি দিয়ে তৈরি ছাদবিহীন গুহার মতো ঘেরা জায়গাগুলিকে বলে বেহড়।

এর থেকে পুরো মালভূমি এলাকাটির নামই হয়ে গেছে বেহড়।



চম্বলের বেহড়

অভিশপ্ত নদী চম্বল

লোকগাথা থেকে জানা যায় আর্যরাজ রন্তিদেব একবার অসীম ক্ষমতার লোভে গোমেধ যজ্ঞ করেন। যজ্ঞের সময় কয়েক সহস্র গাভির বলিদানে চম্বল নদীর জল হয়ে উঠেছিল রক্তবর্ণ। রাজা ও চম্বল নদীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণরা। অন্য আরেকটি লোকগাথা বলছে, দ্রৌপদীকে শকুনি অপমান করার সময় চম্বল নদী নিশ্চুপ থাকায় দ্রৌপদী অভিশাপ দেন চম্বল নদীকে।

দ্রৌপদী ও ব্রাহ্মণদের শাপে চম্বল নদী হয়ে ওঠে অশুভ এবং অভিশপ্ত।
তাই আজও চম্বল নদীর তীরে গড়ে ওঠেনি কোনও জনবসতি ও ধর্মস্থান।
চম্বল ভারতের একমাত্র নদী, যে পূজা পায়না। যার জল দিয়ে কোনও পবিত্র কাজ হয়না। প্রবাদে বলে, “চম্বল নদীর জল যে পান করে সে বাগী হয়ে যায়।”

চম্বলের বেহড় বলে ‘খুন কা বদলা খুন’

বিশ্বের কাছে চম্বলের পরিচিতি তার রুক্ষ সৌন্দর্যের জন্য নয়। কুখ্যাত বাগী বা দস্যুদের মুক্তাঞ্চল হিসেবে। তবে চম্বলের দস্যুদের সঙ্গে ভারতের অনান্য ডাকাতদের মিল পাওয়া যাবে না। চম্বলের দস্যুরা কখনও ব্যাঙ্ক, পেট্রোল পাম্প বা সরকারি খাজানা লুঠ করে না। এখানকার দস্যুরা নিজেদের দস্যু বলেনা, বলে বাগী, যার অর্থ বিদ্রোহী।

এরা বাগী হয় বদলা নেওয়ার জন্য।
রুক্ষ এলাকাটিতে আবহমান কাল ধরে লেগে থাকে জাতপাতের বিদ্বেষ, পরিবার-পরিবারে জমিজমা ও সম্পত্তি নিয়ে লড়াই। বিভিন্ন গ্রামের মধ্যে রেষারেষি, অসহায় ও গরীবদের ওপর ধনীদের অত্যচার। এই সেই চম্বল যেখানে হানাহানি চলে বংশ পরম্পরায়। যেখানে পুর্বপুরুষের অসম্মান বা হত্যার বদলা নেওয়া হয় কয়েক পুরুষ  ।

এলাকাটিতে বন্দুক সিগারেটের মতোই সহজলভ্য হওয়ায়, একদিন হয়তো অত্যচারীকে খুন করে বসে গ্রামের সবচেয়ে শান্ত ছেলেটি কিংবা দিনের পর দিন ধর্ষিতা হতে থাকা মহিলাটি।
খুনের পর পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে তারা পালায় বেহড়ে। তাদের আশ্রয় দেয় চম্বলের বেহড়ে লুকিয়ে থাকা দস্যুদল। কমপক্ষে একটা খুন করলে তবেই জায়গা মেলে দলে। কারণ যে খুন করেছে সে পুলিশ ও বদলার ভয়ে দল ছেড়ে যাবে না। এভাবেই বাড়তে থাকে বাগীদের সংখ্যা।

এভাবেই চম্বল নদী খুব কাছ থেকে দেখেছে মান সিং, লাখন সিং, সুলতান সিং, মালখান সিং, মোহর সিং,সুলতানা গুর্জর ,বাবু গুর্জর, বাবা মুস্তাকিন, পান সিং তোমর, ফুলন দেবী, সীমা পরিহার, নির্ভয় সিং গুর্জর ইত্যাদি নামকরা বাগীদের। আর দেখেছিল দস্যুরাণী পুতলীবাঈকে। ভারতের প্রথম নারী দস্যু। চম্বলের রুক্ষ মাটিকে যে নারী রক্তে রাঙিয়ে দিয়েছিল অপরিসীম আক্রোশে। যাকে ধরতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে গিয়েছিল তিন রাজ্যের পুলিশ বাহিনী।


বেহড়ের সমতল এলাকায় লুকিয়ে আছে বিভিন্ন গ্রাম।
গম, জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা ও  ধানক্ষেত দিয়ে ঘেরা থাকে চম্বলের গ্রামগুলি।

মধ্যপ্রদেশের অম্বা তহশিলের বারাবাই গিরিখাতে সেরকমই একটি গ্রামে ছিল গহরবানুর বাড়ি।
এক হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েছিল গহরবানু।

মা আসগরিবাঈ ছিলেন অসামান্য রূপসী। নাচ ও গান জানতেন। মায়ের রূপ আর গুণ পেয়েছিল গহরবানু। সে ও তার বোন ‘তারা‘ পেটের তাগিদে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও বিয়ে বাড়িতে নাচ গান করত। পুতুলের মত ছোট্টখাট্টো ও মিষ্টি হওয়ার জন্য রসিকরা গহরবানুর নাম দিয়েছিল পুতলীবাঈ।

আসগরিবাঈ বুঝেছিলেন পুতলীবাঈয়ের নাচ ও গানের প্রতিভাকে ছোট এলাকার মধ্যে বেঁধে রাখা উচিত হবে না। মেয়েকে নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন আগ্রা। পুতলীবাঈয়ের নাচে আর গানে মোহিত হয়ে গিয়েছিল আগ্রা শহর। পুতলীবাঈয়ের প্রতিভার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল লখনৌ এবং কানপুরেও।

পুলিশের কানে গিয়েছিল কিশোরী পুতলীবাঈয়ের নাম। রসিক পুলিশের দল পুতলীবাঈয়ের অনুষ্ঠান দেখতে আসতে শুরু করেছিল। ফলে সাধারণ মানুষের ভিড় কমতে শুরু করেছিল। আসগরিবাঈ পুতলীবাঈকে নিয়ে ফিরে এসেছিলেন নিজের গ্রামে।

  অপহৃত হয়েছিল পুতলীবাঈ্

ঢোলপুরের জমিদারের ছেলের বিয়েতে  পুতলীবাঈকে গান গাওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল। বড় অঙ্কের অর্থ উপার্জনের আশায় গিয়েছিল পুতলীবাঈ। নাচ গান আর সুরার নেশায় সবাই যখন বুঁদ, বিয়েবাড়িতে হানা দিয়েছিল চম্বলের ত্রাস সুলতান সিং গুর্জর। টাকাপয়সা, সোনাদানা লুঠ করার সঙ্গে সঙ্গে অপহরণ করেছিল পুতলীবাঈকেও।

পুতলীবাঈকে সুলতান সিং নিয়ে গিয়েছিল বেহড়ের গোপন ডেরায়। কয়েকদিন পরে এক দুর্গামন্দিরে বিয়ে করেছিল পুতলীবাঈকে। দাবানলের মতো খবরটি ছড়িয়ে পড়েছিল চম্বলে। তখনও সুলতানার পরিচয় জানত না সদ্য যুবতী পুতলীবাঈ। কিন্তু সুলতান সিংয়ের মাথার ওপর ৮৪ টি নরহত্যার শমন রয়েছে জেনে এক রাতে ডেরা ছেড়ে পালিয়েছিল  পুতলীবাঈ।

অনেক কষ্টে ও কাঠখড় পুড়িয়ে ফিরে এসেছিল নিজের গ্রামে। প্রবল ঘৃণায় গ্রামবাসী একঘরে করে দিয়েছিল পুতলীকে। কিন্তু তার অপরাধ কী সেটা পুতলী বুঝতে পারেনি। সবাই মুখ ফেরালেও  মা আসগরীবাঈ তাঁর গহরকে ফিরিয়ে দেননি।

পুলিশের অত্যাচারে বেহড়ে ফিরেছিল পুতলীবাঈ

গ্রামে ফেরার পর পুতলীবাঈকে থানায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। সুলতান সিংয়ের সন্ধান জানতে ঘন্টার পর ঘন্টা অত্যাচার চালিয়েছিল নিরীহ পুতলীর ওপর।
সুলতান সিংয়ের বদলার ভয়ে মুখ খোলেনি পুতলী। দিনে রাতে পুতলীকে ডেকে পাঠানো হত থানায়। কখনও কখনও অফিসারেরা নিজেদের বাড়িতে ডেকে পাঠাতেন।
পাশবিক অত্যাচার চলত পুতলীর ওপর।
একসময় এটাই রুটিন হয়ে গিয়েছিল বিধ্বস্ত পুতলীর।

পুলিশ ও গ্রামবাসীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে,  একদিন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল পুতলী। ফিরে গিয়েছিল সুলতান সিংয়ের কাছে। খোলা আকাশের নীচে, চম্বলের বেহড়ের রুক্ষ নিরাপত্তায় শুরু করেছিল সংসার। আজ এখানে তো কাল কুড়ি কিলোমিটার দূরে কোনও নিরাপদ ডেরায় কাটত পুতলীর রাত।


এভাবেই একদিন বেহড়ে পালিয়ে গিয়েছিল পুতলী

 বাগী জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিল পুতলী

বেহড়ের মধ্যেই জন্ম নিয়েছিল সুলতান সিং ও পুতলীর মেয়ে ‘তান্নো’। তান্নোকে পুতলী  রেখে এসেছিল তার মায়ের কাছে। বন্দুক আর রক্ত থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিল মেয়েকে। কারণ বেহড়ের জীবন নির্ভর করে একটি মাত্র গুলির ওপরে।
কে কতক্ষণ গুলিটিকে দূরে রাখতে পারে তারই লড়াই চলে প্রতিনিয়ত।

পুতলীবাঈকে বন্দুক চালানো শিখিয়েছিল সুলতান সিং। পুলিশের সঙ্গে একটি এনকাউন্টারে পুতলীর নিখুঁত নিশানায় উড়ে গিয়েছিল পুলিশের চরের মাথার খুলি। সেদিন পুতলীবাঈ উপহার পেয়েছিল একটি রাইফেল। কিন্তু পুতলীবাঈ সেদিন নামিয়ে রেখেছিল রাইফেল, বেহড়ের জীবন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল।

হত্যার কলঙ্ক মাথায় নিয়ে ফিরতে চেয়েছিল মেয়ের কাছে। মেয়েকে একটিবার চোখে দেখার জন্য। কারণ পুতলী জানত সেদিন থেকে পুলিশের রাইফেলের নল ঘুরে গিয়েছিল তারও দিকে। কিন্তু সেদিন পুতলীকে  বেহড় ছাড়তে দেয়নি সুলতান সিং। কারণ দলে সুলতান ক্রমশ একা হয়ে পড়ছিল। পুতলী ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিল না সুলতান।

বেহড়ের নির্মমতায় একা হয়ে গিয়েছিল পুতলী

একদিন রাতে গোপন ডেরায় শুয়েছিল সুলতান আর পুতলী। কয়েকজন পাহারা দিচ্ছিল। দলের বাকি সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল আশেপাশে। অতর্কিতে হানা দেয় পুলিশ। শুরু হয় ‘মুঠভেড়’। সেই রাতের এনকাউন্টারে মারা যায় সুলতান সিং। পুতলীর চোখের জলে ভিজেছিল বেহড়ের মাটি।

এরপর প্রতিরাতে দলের নতুন ‘সরগনা’ দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল পুতলী। বুঝতে পেরেছিল তার স্বামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। গোপন ডেরার খবর পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। দলের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে বলি হয়েছে সুলতান সিং।

কিন্তু এ পুতলীবাঈ সে পুতলীবাঈ নয়, বেহড়ের পুতলীবাঈয়ের পায়ে ঘুঙুর ছিল না। চম্বল নদীর জল পুতলীবাঈকে তার নিজের অজান্তেই করে তুলেছিল হায়নার মতোই হিংস্র। স্বামীর মৃত্যু ও পুলিশের অত্যাচারের বদলা নিতে পুতলীবাঈ তুলে নিয়েছিল নামিয়ে রাখা রাইফেল।

সবার আগে খুন করেছিল দলের নতুন নেতাকে। তারপর  সুলতান সিংয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা সদস্যদের ঠান্ডা মাথায় একে একে খুন করেছিল পুতলী। পোড় খাওয়া বাগীরা চমকে উঠেছিল পুতলীবাঈয়ের নৃশংসতায়।

 পুতলীবাঈ থেকে দস্যুরাণী পুতলী

সুলতান সিংয়ের দলের কর্তৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল পুতলী। তারপর পুলিশদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুষে রাখা ক্ষোভ নিয়ে। এক রাতে দাতিয়া গ্রামের ১১ গ্রামবাসীকে পুতলীবাঈ গুলি করে হত্যা করেছিল। তার সন্দেহ হয়েছিল সেই গ্রামের বাসিন্দারা পুলিশের চর। কারণ পুতলীর ‘মুখবীর’ (দস্যুদের চর) সেরকমই তথ্য দিয়েছিল।

১৯৫০ থেকে ১৯৫৮, চম্বলে নিরবিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস চালিয়েছিল পুতলীবাঈ। খুন, অপহরণ, তোলা আদায় কিছুই বাদ দেয়নি পুতলী। বার বার পুতলীকে এনকাউন্টারে মারতে চেষ্টা করেছে পুলিশ। কিন্তু বেহড়ের ভেতরে থাকা পুতলীবাঈ চম্বল নদীর জলে থাকা কুমীরের চেয়েও চালাক ও ভয়ঙ্কর। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই সে বেহড়কে চিনে নিয়েছে নিজের হাতের তালুর মতো। পালটা আক্রমণে দিশেহারা করে দিত পুলিশবাহিনীকে। কখনও খালি হাতে, কখনও সঙ্গী পুলিশদের মৃতদেহ নিয়ে ফিরতে হত পুলিশবাহিনীকে।

পুলিসের সঙ্গে একটি এনকাউন্টারে হাতে গুলি লেগেছিল পুতলীবাঈয়ের। পচন ধরা হাতটি কনুই থেকে কেটে ফেলতে হয়েছিল। গোয়ালিয়রের  ডাক্তারকে সেই সময়ে ২০০০০ টাকা দিয়েছিল পুতলী। হাত হারানোর পর পুতলীর নৃশংসতা আরও বেড়ে গিয়েছিল। ছিপছিপে ছোটখাটো চেহারার পুতলীবাঈ এক হাতে ভারী রাইফেল তুলে নিখুঁতভাবে গুলিবর্ষণ করে একইভাবে তার সন্ত্রাসের রাজত্ব ধরে রেখেছিল।

 চম্বলের জলে বয় বিশ্বাসঘাতকতার স্রোত

সুলতান সিংয়ের মৃত্যু ও দলের বিশ্বাসঘাতকদের হত্যার পর একাধিক সদস্য পুতলীকে বিয়ে করতে চায়। সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছিল পুতলীবাঈ। কিন্তু ফেরাতে পারেনি কল্লা গুর্জর নামে এক সুঠাম চেহারার যুবককে। বেহড়ের নিভৃতে শুরু হয়েছিল পুতলী ও কল্লার প্রেম।

প্রেমে মশগুল পুতলী বুঝতে পারেনি, চম্বল নদীর জলে, বেহড়ের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে বিশ্বাসঘাতকতার বীজ। ধীরে ধীরে নিজেকে অসুরক্ষিত করে ফেলেছিল পুতলী। পুতলী ও কল্লার প্রেম মেনে নিতে পারেনি দলের অনেক সদস্য।

২৩ জানুয়ারি, ১৯৫৮। ছাতি গ্রামের অদূরে ছিল পুতলীর গ্যাং ( মতান্তরে শিবপুরীর জঙ্গল)। কেউ বলে লাখন সিংয়ের গ্যাংকে এনকাউন্টার করতে গিয়ে পুতলীর গ্যাংয়ের সামনে গিয়ে পড়ে পুলিশ। কেউ বলে পুতলীর গ্যাংয়ের কেউ জানিয়ে দিয়েছিল পুতলীর ডেরা। সেদিন চম্বলের বেহড় দেখেছিল এক রুদ্ধশ্বাস লড়াই।

চম্বল নদী আশ্রয় দিয়েছিল পুতলীকে

মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজে কাঁপছিল চম্বলের বেহড়। রাতভোর চলেছিল গুলির লড়াই। পুতলী বুঝতে পেরেছিল তার দলের বন্দুকগুলি ক্রমশ শান্ত হয়ে যাচ্ছে। সেদিন নিদারুণভাবে প্রতারিত হয়েছিল পুতলী। চম্বলের বেহড় এক নারীর দখলে থাকবে, হয়তো মেনে নিতে পারেনি বেহড়ের পৌরুষ।

ছাতি গ্রামের কিছু দূর দিয়ে বয়ে চলেছিল চম্বল নদী। কুমীর ভর্তি নদী একহাতে সাঁতরে পার হতে চেয়েছিল পুতলীবাঈ। সঙ্গে ছিল প্রেমিক কল্লা। আর মাত্র কয়েক ফুট, তারপরে পুতলী চলে যেত পুলিশের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু বাতাসে শীষ কাটতে কাটতে উড়ে এসেছিল বুলেট। একটার পর একটা। পুলিশের নাকি নিজের দলের বিশ্বাসঘাতকদের বুলেট, তা বুঝতে পারেনি পুতলী।


ডাঙায় আর উঠতে পারেনি। চম্বল নদীর রুক্ষ তীরে পিঠ ঠেকিয়ে ৩২ বছরের পুতলী শেষ করেছিল তার অভিশপ্ত জীবন। মৃত্যুর সময় চোখটা খোলাই ছিল। হয়তো সে দেখতে চেয়েছিল বিশ্বাসঘাতকদের, হয়তো তার মেয়ে তান্নোকে। কিন্তু সুযোগ কাউকে দ্বিতীয়বার দেয় না চম্বল। দেয়নি দস্যুরানি হয়ে ওঠা গহরবানুকেও।

--------------------------

Tuesday, July 13, 2021

17>|| তুলসীদাসজীর জীবনী ও হনুমান চাল্লিশা |

 

17>|| তুলসীদাসজীর জীবনী ও হনুমান চাল্লিশা  ||

         হিন্দি ও বাংলা।

|| हनुमान चालीसा की कहानी  ||

                   <--अद्यनाथ-->

1600 ईसबी की अकबर और तुलसीदास जी की  एक स्तय कहानी ।

कहानी इस प्रोकर--

 एक बार तुलसीदास जी मथुरा जा रहे थे। रस्था में रात होने से पहले उन्होंने अपना पडाव आगरा में डाला।

ऐ समाचार चारो और फेला, लोगो को पता लगा की तुलसी दास जी आगरा में पधारे है। 


यह सुन कर उनके दर्शनों के लिए लोगो का ताँता लग गया। थोड़ेही देर में  यह बात जब बादशाह अकबर को पता लगी तो उन्होंने वीरबल से  तुलसीदास के बारे पुंछा की यह तुलसीदास कौन हैं.....?


 वीरबल ने बताया, इन्होंने तुलसीदास जी।

इन्होंने ही रामचरितमानस का अनुवाद किया है यह रामभक्त तुलसीदास जी है।

"में भी इनके दर्शन करके आया हूँ।"


इतना सुनकर सम्राट अकबर ने भी उनके दर्शन की इच्छा व्यक्त की और कहा "में भी उनके दर्शन करना चाहता हूँ।"

अतः बादशाह अकबर ने अपने सिपाहि को तुलसीदास जी के पास भेजा। और सिपाहि,  तुलसीदास जी को बादशाह का पैगाम सुनाया, की "आप लाल किले में हाजिर हों।" यह पैगाम सुन कर तुलसीदास जी ने कहा की "मैं भगवान श्रीराम का भक्त हूँ, मुझे बादशाह और लाल किले से मुझे क्या लेना देना," 

और लाल किले जाने की साफ मना कर दिया। जब यह बात बादशाह अकबर को पता चला  तो  अकबर की बहुत बुरी लगी और बादशाह अकबर गुस्से में आग बबूला हो गई ,

और उन्होंने तुलसीदास जी को पकड़ कर

 लाल किला लाने का आदेश दिया। 


जब तुलसीदास जी लाल किला पहुंचे तो अकबर ने कहा की "आप कोई करिश्माई व्यक्ति लगते हो, कोई करिश्मा करके दिखाओ।" तुलसी दास ने कहा " मैं तो सिर्फ भगवान श्रीराम जी का भक्त हूँ कोई जादूगर नही हूँ जो आपको कोई करिश्मा दिखा सकूँ।" अकबर यह सुन कर और भी गुस्से में आदेश दिया की" इनको जंजीरों से जकड़ कर काल कोठरी में डाल दिया जाये।"


दूसरे दिन सबेरे  आगरा के लाल किले पर लाखो बंदरो, हनुमान ने एक साथ हमला बोल दिया पूरा किला तहस नहस कर डाला। लाल किले में त्राहि त्राहि मच गई।

 तब अकबर ने वीरबल को बुला कर पूंछा की "वीरबल यह क्या हो रहा है....?"

वीरबल ने कहा

 "हुज़ूर आप करिश्मा देखना चाहते थे तो देखिये। एहि एक करिश्मा।"


अकबर ने तुरंत तुलसी दास जी को कल कोठरी से निकल कर उनकी जंजीरे खोल दी ।

तब तुलसीदास जी ने वीरबल से कहा---

 "मुझे बिना अपराध के सजा मिली है। मैने काल कोठरी में भगवान श्रीराम और हनुमान जी का स्मरण किया में रोता जा रहा था। और मेरे हाथ अपने आप कुछ लिख रहे थे यह 40 चौपाई, हनुमान जी की प्रेरणा से लिखी गई इस चौपाई

जो भी व्यक्ति कष्ट में या संकट में  होगा और इसका पाठ करेगा ,उसके कष्ट और सारे संकट दूर होंगे। इसको हनुमान चालीसा के नाम से जाना जायेगा।"

अब अकबर बहुत लज्जित हुए और तुलसीदास जी से माफ़ी मांगी, और पूरी इज़्ज़त और पूरी हिफाजत और लाव लश्कर के साथ  तुलसीदास जी को मथुरा भिजवाया।


आज लोग हनुमान चालीसा का पाठ करते हैं। और सभी पर हनुमान जी की कृपा बर्षते हैं।

 और सभी के संकट दूर हो रहे है। हनुमान जी को इसीलिए "संकट मोचन" भी कहा जाता है।

।। जय श्री राम, जय श्री हनुमान ।।


<--©--➽-ए एन राय चौधुरी-->


========================

  || হনুমান চালিশার কাহিনী ||


সম্রাট আকবর এবং তুলসীদাস।


আজ অনেকেই রোজ নিয়ম করে 

হনুমান চালিশা পাঠ করেন।

কিছু মানুষ বিপদে পড়লেই হনুমান চালিশা পাঠ করেন এবং হনুমানজীর সরনাপন্ন হন।

আমরা এও জানি যে এই হনুমান চালিশার রচয়িতা গোস্বামী তুলসীদাসজী।

কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে তুলসীদাসজী এই হনুমান চালিশা রচনা করেছিল সেই সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করে কিছু বই খুঁজে, কিছু ইন্টারনেট খুঁজে যেটুকু জেনেছি ::------

গোস্বামী তুলসীদাস জী এই রচনা হয়েছিল ষোড়শ শতকে মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কালে সম্ভবত 1582 সালে। তবে হনুমান চালিশা রচনার সময়কাল নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে নানান মত বিরোধ রয়েছে। 

কেউ কেউ মনে করেন যে হনুমান চালিশা অনেক পরে রচনা করা হয়েছিল। 

আবার কেউ মনে করেন যে তুলসীদাসজী শৈশবেই এটি রচনা করেছিলেন।

তবে বেশির ভাগ পণ্ডিতগণের

মত হল হনুমান চালিশা তুলসীদাসজী রচনা করেন আঠার শতকের আটের দশকে।

মূল হনুমান চালিশা  রচিত হয়েছিল অবধি ভাষায়। অবধি হল হিন্দি ভাষার একটি রুপ। 

এটি তুলসীদাস রচিত রামচরিতমানসের একটি অংশ বিশেষ। 

এখানে  তুলসীদাসজীর একটু পরিচিতি

জানা উচিত বলে মনে করি। 

তুলসীদাসজীর জন্ম হয় প্রয়াগের কাছে চিত্রকূট জেলার রাজপুর গ্রামে। তার জন্ম সাল নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট মতোবিরোধ রয়েছে। তবে বাল্মিকী সম্বত অনুযায়ী তার জন্ম 1554সালে।

পিতা আত্মারাম দুবে ও মাতা হুলসির ঘরে 12 মাস মাতৃ গর্ভে থাকার পর জন্ম নেয় 32 টি দাঁত যুক্ত সাড়ে পাঁচ বছরের বালকের মত আকৃতি যুক্ত এক নবজাতক। সন্তানের অমঙ্গলের কথা ভেবে মা হুলসী তার পিতার বাড়ির এক দাসী চুনিয়ার কাছে ছেলেকে গচ্ছিত রাখেন। কিছু দিন পরে চুনিয়াও মারা যায় ও বালক অনাথ হয়ে যায়। এরপরে অনাথ খুব দুঃখ কষ্টের মধ্যে ভিক্ষে করে দিন কাটায়।

এরপরে অনন্তনন্দজীর শিষ্য শ্রীনরহরি আনন্দজী এই বালকে খুঁজে পান এবং অযোধ্যা নিয়ে আসেন এবং নাম রাখেন রামবোলা। সেই অযোধ্যাতেই তিনি রাম মন্ত্রে দীক্ষা নেন এবং বিদ্যা অধ্যয়ন করেন। সেখান থেকে কাশী চলে যান এবং দীর্ঘ 15 বছর বেদ বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করেন। তারপর আবার ফিরে আসেন জন্ম ভূমিতে।

সম্ভবত 1583 সালে বিবাহ হয় রত্নাবলীর সঙ্গে। একদিন রত্নাবলী তার পিতৃ গৃহে গেলে তুলসীদাসজীও পেছন পেছন তার শ্বশুর বাড়ি চলে যান। সেই সময় তার স্ত্রী তাকে তীব্র ভৎসনা করে বলেন আমার মত রক্ত মাংসের শরীরের মোহ ছেড়ে রঘুবীরের নামে জীবনকে সপে দাও। জীবন তোমার মুক্ত হবে। এই কথা শোনা মাত্র তুলসীদাসজীর অন্তরে সম্বিত ফিরে আসে এবং তখনই সাংসারিক জীবন ত্যাগ করে প্রয়াগে চলে আসেন এবং শ্রীরামের নামে জীবন সপে দেনা।

অযোধ্যাতে তিনি দেখা পান হনুমানজীর এবং তিনি শ্রীরঘুনাথের দর্শন পাওয়ার ইছা প্রকাশ করেন। হনুমানজী বলেন শ্রীরামের দর্শন পেতে গেলে চিত্রকূট যেতে হবে। তিনি সেখানে গেলেও শ্রীরামজীকে তিনি চিনতে পারেন নি। পরবর্তীতে শ্রীরাম এক শিশুর বেশে এলে হনুমানজীর ইশারায় তুলসীদাসজী শ্রীরামের দর্শন পান।

তুলসীদাসজী দেহত্যাগ করেন 1623 সালে শ্রাবন মাসে গঙ্গার অসী ঘাটে। কথিত আছে তিনি 126 বছর জীবিত ছিলেন।

রামচরিত মানস  তুলসীদাসজীর এক অমর কীর্তি যাকে তুলসীদাসী রামায়ন বলা হয়। গোটা রামচরিত মানস তিনি শেষ করেন 2 বছর 7 মাস 26 দিনে। এছাড়া তিনি তুলসীদাসী দোহাবলী, কবিতাবলী, গীতাবলী,কৃষ্ণাবলী এবং বিনয় পত্রিকা রচনা করেন। বারানসীর সঙ্কট মোচন হনুমান মন্দিরও তারই সৃষ্টি।

হনুমান চালিশা রচনার ইতিহাস : 

ভারতে তখন মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল। ততদিনে তুলসীদাসজী এক সিদ্ধ পুরুষ হয়ে উঠেছেন। একবার তিনি এক গাছের নীচে বসে ধ্যান করছিলেন। এক মহিলা এসে তাকে প্রণাম করেন। তুলসীদাসজী তাকে সুখী হবার আশীর্বাদ করেন। আশীর্বাদ পেয়ে মহিলা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি মহিলাকে কান্নার কারন জিজ্ঞেস করাতে মহিলা বলেন এই মাত্র তার স্বামী মারা গেছেন। তুলসীদাসজী বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে রাম নাম নেবার পরামর্শ দেন। মহিলা বাড়ি গিয়ে রাম নাম শুরু করেন সঙ্গে উপস্থিত সকলেই রাম নাম করতে থাকেন। কিছুক্ষন পরেই মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে ওঠেন। এই রকম তিনি এর আগেও এক দৃষ্টি হীন ব্যক্তিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেন। তার কীর্তি দাবানলের মত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

এই খবর সম্রাট আকবরের কান পর্যন্ত পৌছায়। আকবর বীরবল ও টোডরমলকে পাঠায় খবরের সত্যতা যাঁচাইয়ের জন্য। তারা খবর নিয়ে এসে সম্রাটকে বলেন যে ঘটনা সত্য। আকবর তুলসীদাসজীকে রাজ সভায় ডেকে পাঠান এবং কিছু চমৎকার দেখাতে বলেন। তুলসীদাসজী সেটা  করতে অস্বীকার করে বলেন "আমি কোন চমৎকারী বাবা নই যে চমৎকার দেখাব। চমৎকার দেখানেওয়ালাতো স্বয়ং শ্রীরাম। আমি নই।"

এই কথা শুনে সম্রাট আকবর প্রচণ্ড ক্রোধিত হয়ে তুলসীদাসজীকে আটক করবার নির্দেশ দেন এবং সেপাইরা তাকে ফতেপুরসিক্রিতে আটক করে রাখেন। তুলসীদাসজী বিন্দু মাত্র বিচলিত না হয়ে শ্রী হনুমান চালিশার রচনা শুরু করেন। হনুমান চালিশার রচনা যখন প্রায় শেষ তখন ফতেপুরসিক্রি সমেত গোটা রাজধানীতে কয়েক লক্ষ বানর হামলা করেন। বানরের অত্যাচারে সম্রাট সহ রাজধানীর সকল নাগরিক অতিষ্ট হয়ে ওঠে। বিচক্ষন সম্রাট আকবরের নিজের ভুল বুঝতে সময় লাগে নি। তিনি দ্রুত তুলসীদাসজীকে কয়েদ থেকে মুক্ত করেন এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তুলসীদাসজী মুক্ত হতেই বানরের উপদ্রব বন্ধ হয়ে যায়। সম্রাট আকবর আমৃত্যু তুলসীদাসের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক রেখেছিলেন।

হনুমান চালিশার উদ্দেশ্য : 

বলা হয় হনুমান চালিসা পাঠ করলে সমস্ত সঙ্কট দূর হয়ে যায়। এই হনুমান চালিশায় হনুমানজীর ক্ষমতার গুণকীর্তন করা হয়। এরও কারন রয়েছে। হনুমানজী ছোট বেলায় ধ্যান মগ্ন মুণি ঋষিদের খুব বিরক্ত করতেন। তাই তাকে মুণি ঋষিরা অভিশাপ দিয়ে ছিলেন যে তার ক্ষমতা বা শক্তি সম্পর্কে তিনি ভুলে যাবেন। অন্য কেও তাকে তার ক্ষমতা না মনে করিয়ে দিলে তিনি তা প্রয়োগ করতে ভুলে যাবেন। তাই হনুমান চালিশার অধিকাংশ চৌপাইতে তার ক্ষমতার কথা উল্লেখ রয়েছে।

        " সংগ্রহ"

<--©➽-আদ্যনাথ রায় চৌধুরী--->

=========================