28>|| কালী বা কালিকা= বর্ননা||
কালী বা কালিকা তাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায় কালীপূজা করে থাকে। তন্ত্র অনুসারে, কালী দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত।
কালী দুর্গার ললাট থেকে উৎপন্না হয়েছেন—এই বাক্যের তাৎপর্য যে, ললাটের সংকোচনেই ক্রোধভাব প্রকাশিত হয় বলে সদা ক্রোধান্বিতা; রণরঙ্গিনী করাল-বদনা কালীকে ললাট-সম্ভবা বলা হয়েছে। বাস্তবিক কালীও দুর্গার রূপান্তর বিশেষ। ক্রোধাবস্থাপন্না শক্তিকেই কালী বলা হয়েছে।
চণ্ডবধ কালে অসুরগণ সহ যুদ্ধ করতে করতে ক্রোধভরে ভগবতীর মুখ কৃষ্ণবর্ণ হয়ে উঠার পর তাঁহার ললাটদেশ হতে করালবদন অসি-পাশ প্রভৃতি অস্ত্রপাণি কালিকাদেবীর আবির্ভাব হয়েছিল। (মার্কণ্ডেয় পুঃ ৮৭/৫)
কালিকাপুরাণে এর রূপাদি এভাবে বর্ণন আছে –
“নীলোৎপলের ন্যায় শ্যামবর্ণ, চারহাত, দক্ষিণহাত দুইটিতে খট্বাঙ্গ ও চন্দ্রহাস, বামহাত দুইটিতে চৰ্ম্ম ও পাশ, গলায় মুণ্ডমালা, পরনে বাঘের চামড়া, কৃশাঙ্গ, দাঁত দীর্ঘ, অতিভয়ঙ্কর লোলজিহবা, আরক্তচক্ষু, ভীমনাদ, কবন্ধ বাহন, বিস্তৃত মুখ ও কর্ণ স্থুল। এই দেবী তারা ও চামুণ্ডা নামেও অভিহিত হয়ে থাকেন। এর আটজন যোগিনী তাদের নাম-ত্রিপুরা, ভীষণা, চণ্ডী, কত্রী, হন্ত্রী, বিধাতৃকা, করালা ও শূলিনী। এই সকল যোগিনীগণও দেবীর সাথে পূজিত এবং অনুধ্যাত হয়ে থাকেন। দেবীগণের মধ্যে এরই পূজা করলে সৰ্ব্বকামনা সিদ্ধ হয়।” (কালিকা ৬০ অঃ)
তিনি দশ মহাবিদ্যার মধ্যে প্রথম মহাবিদ্যা। যথা তন্ত্রসারে,—
“কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।
ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধুমাবতী তথা ॥
বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।
এতা দশ মহাবিদ্যা সিদ্ধবিদ্যাঃ প্রকীৰ্ত্তিতাঃ ॥
কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধুমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা এই দশমূর্ত্তির নাম দশ মহাবিদ্যা; তাঁদের সিদ্ধবিদ্যা ও বলা হয়ে থাকে। সতী দক্ষযজ্ঞে যাবার সময় শিবের নিকট বারবার অনুমতি চাইলেন, কিন্তু মহাদেৰ কোনক্রমেই তাঁকে অনুমতি না দেওয়ায় সতী এই রূপে দশমূর্ত্তি ধারণ করে শিবকে ভীত করেছিলেন এবং তাঁর অনুমতি পেয়েছিলেন।
যত কন সতী শিব না দেন আদেশ।
ক্রোধে সতী হৈলা কালী ভয়ঙ্করবেশ ॥ (অন্নদা মঙ্গল ২৯)
কালীমূর্ত্তির ধ্যান মন্ত্র যথা-----
ওঁ করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম্।
কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুন্ডমালাবিভূষি তাম্ ॥
সদ্যশ্চিন্নশিরঃ খড়গবামাধোর্দ্ধক রাম্বুজাম্।
অভয়ং বরদঞ্চৈব দক্ষিণোদ্ধার্ধপাণিকাম্ ॥
মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব দিগম্বরীম্।
কন্ঠাবসক্তমুন্ডালী-গলদ্রুধিরচর্চিতাম্ ॥
কর্নাবতংসতানীতশ বযুগ্মভয়ানকাম্।
ঘোরদ্রংষ্টাং করালস্যাং পীণোন্নতপয়োধরাং ॥
শবনাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মখীম্।
সৃক্কদ্বয়গলদ্রক্ত-ধারাবিস্ফুরিতাননাম্ ॥
ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শ্মশ্মানালয় বাসিনীম্।
বালার্কমণ্ডলাকা রলোচনত্রিয়ান্মি তাম্ ॥
দস্তুরাং দক্ষিণব্যপিমুক্ তালম্বিকচোচ্চয়া ম্।
শবরূপমহাদেবহৃদয় োপরি সংস্থিতাম্ ॥
শিবাভির্ঘোররাবা ভিশ্চতুর্দিক্ষু সমন্বিতাম্।
মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম ॥
সুখপ্রসন্নবদনাং স্মেরানন সরোরুহাম্।
এবং সঞ্চিন্তেয়ৎ কালীং সর্বকাম- সমৃদ্ধিদাম্ ॥ (তন্ত্রসার)
দেবী দক্ষিণা কালী করালবদনা ভয়ঙ্করী, মুক্তকেশী ও চতুর্ভুজা, তিনি দিব্য জ্যোতি সম্পূর্ণা, মুন্ডমালা ধারিণী। মায়ের বামদিকের নিচের হাতে সদ্যচ্ছিন্নিত মুণ্ড, উপরের বাম হাতে খড়গ। ডানদিকের উপরের হাত অভয় মুদ্রায় এবং নিচের হাত বরমুদ্রা ধারণ করে আছেন। মায়ের গায়ের রং কালো মেঘের প্রভার মত শ্যামা। তিনি দিগম্বরী অর্থাৎ বস্ত্রহীনা। উনার গলার মুন্ডমালা গুলো থেকে বের হওয়া রক্ত উনার দেহ কে রঞ্জিত করছে, দুটি শবশিশু তার কর্ণভূষণ হওয়াতে দেবীকে ভয়ঙ্করী দেখাচ্ছে। তিনি তাঁর দাঁত দিয়ে নিজের জিহ্বাকে কামড় দিয়ে আছেন, তিনি কোমরে বেঁধে রেখেছেন হাতের মালা। তাঁর মুখে মৃদুহাসি এবং উনার মুখ থেকে রক্তের ধারা বের হচ্ছে আর উনার মুখে অনন্ত কোটি সূর্যের তেজ বিদ্যমান। তিনি অতিশয় ক্রোদ্ধা, ভয়ংকর নাদকারিণী, উনার তিনটি চোখ আর সেই সকালের সূর্যের মত লালপ্রভাময়। উনার চারদিকে চিৎকার করছে শিয়ালের দল। আমি সেই দেবীর ধ্যান করি যিনি শবরুপ মহাদেবের হৃদয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। যার মুখ সুখ-প্রসন্নতায় ভরা। যিনি মোক্ষদায়িনী এবং সকল ইচ্ছাপূরণকারিণী।
দেবীর অঙ্গের তাৎপর্যঃ
দেবীর মাথায় অর্দ্ধচন্দ্র তাঁহার মোক্ষ-প্রদান শক্তির পরিচায়ক।তাহা হইতে নিঃসৃত অমৃত সাধক কে অমৃতত্ব বাঁ মোক্ষ প্রদান করিয়া থাকে। দেবী মুক্তকেশী। তাঁর মুক্তকেশ চির-বৈরাগ্যের প্রতীক। জ্ঞান-অসির আঘাতে তিনি অক্টপাশ ছেদনকারী মা চির বৈরাগ্যময়ী। তাই তাঁর কালো চুল বিস্তৃত।
দেবীর তিন চোখ তিনটি আলোর প্রতীক, চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি। অন্ধকার বিধ্বংসী তিন শক্তির প্রকাশ। অজ্ঞতা, চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার থেকে মুক্ত করে। তিনটি চোখে দেবী অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে প্রত্যক্ষ করেন। কারণ,এই শক্তিই হল সৃষ্টি স্থিতি ও প্রলয়ের কর্তা। দেবীর কানে দুতি বালকের শব যার অর্থ নির্ব্বিকার, নিস্কাম,শিশু্ভাবাপন্ন সাধক মায়ের অতি প্রিয়। দেবী রক্তবর্ণের জিহ্বাকে সাদা দাঁত দিয়ে কামড়ে রেখেছেন। লাল রং রজোগুণের প্রতীক, সাদা রং সত্ত্বগুণের প্রতীক। সাদা দাঁত দিয়ে লাল জিহবাকে চেপে রাখা। অর্থাৎ সত্ত্বগুণর দ্বারা রজোগুণকে দমন করে রাখা। রজোগুণ ভোগের গুন, ঈশ্বর বিমুখ করে। রজোগুণ দমনের জন্য এই প্রতীক। অনেক সময় আমরা কোন অন্যায় বা মিথ্যাচার করলে জিহ্বার কামড় দেই অর্থাৎ অন্যায় করার স্বীকৃতি।
দেবীর গলায় পঞ্চাশটি মুন্ড দিয়ে মালা পরানো। পঞ্চাশটি মুন্ড পঞ্চাশটি অক্ষরের প্রতীক। ১৪ টি স্বরবর্ণ এবং ৩৬ টি ব্যঞ্জনবর্ণ, অক্ষর ব্রহ্ম, যার ক্ষয় নেই, শব্দ ব্রহ্ম, অক্ষরের দ্বারাই শব্দের উৎপত্তি হয়। এর অবস্থান মস্তকে। আমরা মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা দেব বা দেবীর বন্দনা করি। এই মন্ত্রের অবস্থান মাথার তালুতে সহস্রার পদ্মের মধ্যে। তাই অক্ষরের প্রতীক মুন্ড তাঁর গলায় হাত কর্মের প্রতীক। আমাদের সকল কর্মের ফলদাতা তিনি। সকাম ভক্ত যারা তারা অতৃপ্ত কামনা নিয়ে দেহত্যাগ করে বলে পুনরায় মাতৃ জঠরস্থ হয়, হস্ত মেখলা প্রতীকে সকাম ভক্তের পুণর্জন্ম লাভ করার তত্ত্ব নিহিত।
দেবীর চাইতে বড়তো কিছুই নেই। তাই তিনি কি পরিধান করবেন? বিশ্বব্যাপী শক্তির অবস্থান। শক্তিকে আবরিত করা যায়না। তিনি স্বয়ং প্রকাশ। তাই দেবী উলঙ্গ।দেবী কখন দক্ষিণ পদ কখন বাম্পদ, অগ্রে স্থাপন করেন ইহার অর্থ এক পদে অতীতকে অন্যপদে ভবিষ্যত কে অধিকার করিয়া আছেন।
কালো রং সকল বর্ণের অনুপস্থিত। তাই কালো। কখনো বা তিনি শ্যমা- শ্যামবর্ণা। কালো রং ভয়ের উদ্রেক করলেও শ্যাম রং কোমলতা জাগায়। স্নিগ্ধতা ও কমনীয়তা জাগায়। তাই মাতৃসাধক কালী শ্যামবর্ণা রূপেও দর্শন করেছেন।
মা কালী শবরূপী শিবের বুকে দন্ডায়মানা। শিব স্থির, কালী গতিময়ী। গতি ঠিক রাখতে হলে স্থিরের উপর তার প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। শিব শুভ্রবর্ণ, কালী কালো বর্ণ। সাধক কূটস্থ দর্শন কালে এই শুভ্র রং বেষ্ঠিত কালো রং সাধনায় দেখে থাকেন।
কালীর রূপকল্পনাঃ-
মহাকালী, দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, গুহ্যকালী ও রক্ষাকালী প্রভৃতি নাম অনুসারে কালীমূৰ্ত্তির বিবিধ ভেদ আছে। ইনিই মূল প্রকৃতি; স্বল্পবুদ্ধি ও দুৰ্ব্বল মানুষের উপাসনা কার্য্যে সুবিধা করবার জন্যই তন্ত্রা আদিশাস্ত্রে এই প্রকৃতির কালী, তারা প্রভৃতি নাম ও রূপ কল্পিত হয়েছে। মহানিৰ্ব্বাণতন্ত্রেও এভাবে লেখা আছে-
“উপাসকানাং কার্য্যায় পুরৈব কথিতং প্রিয়ে।
গুণক্রিয়ানুসারেণ রূপং দেব্যাঃ প্রকল্পিতম্ ॥
(মহানিৰ্ব্বাণ ১৩ উল্লাস।)
উপাসকদের কার্য্যের সুবিধার জন্যই গুণক্রিয়া অনুসারে দেবীর রূপ কল্পিত হয়েছে।
আদ্যশক্তির প্রধান মূৰ্ত্তি কালী। শাক্ত উপাসকের মধ্যে প্রায় দশআনা লোক এই মূৰ্ত্তির উপাসক। ভগবতীর যতগুলি মূৰ্ত্তি আছে, তারমধ্যে দুর্গা ও কালীমূৰ্ত্তির বছল প্রচার। এই মূর্ত্তির কল্পনা কতকাল পূর্ব্ব হতে চলে আসছে, তা সহজে নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিত ও সেই মতাবলম্বী প্রাচ্য পণ্ডিতরা বলেন, এই মূৰ্ত্তি হিন্দুদের মৌলিক মূৰ্ত্তি নয়, ভারতের আদিম অধিবাসী অনাৰ্য্যদের দেবদেবী হতে সংগৃহীত হয়েছে। এরূপ মীমাংসা বা কল্পনায় কোন ফল আছে কি না তাহা বুঝা যায় না; কারণ, অনেক অনেক প্রাচীন পুরাণে ভগবতীর এই মূৰ্ত্তির কথা পাওয়া যায়। তবে এই পৰ্য্যন্ত স্বীকার করতে হবে যে, তান্ত্রিক যুগেই এই মূৰ্ত্তির উপাসনার নানাবিধ বিধি-নিয়ম সঙ্কলিত ও বহুল প্রচার হয়েছে।
তন্ত্রের কথা ছেড়ে আগে দেখা যাক, পুরাণ আদিতে ভগবতীর কালীমূর্ত্তির উৎপত্তি, পূজা, ধ্যান ইত্যাদি সম্বন্ধে কি কি বিবরণ পাওয়া যায়।
পুরাণের মধ্যে মার্কণ্ডেয় পুরাণখানি অপেক্ষাকৃত প্রাচীন বলে গণ্য। দেবীমাহাত্ম্য চণ্ডী-যা পাঠ বা শ্রবণ করলে ইন্দ্রের ঐশ্বৰ্য্যতুল্য ঐশ্বৰ্য্য ভোগ হয়—সেই চণ্ডীই এই পুরাণের অন্তর্গত। কালিকামূৰ্ত্তির উৎপত্তির কথা চণ্ডীতে দুই স্থানে কথিত হয়েছে। প্রখম,-মহিষাসুর বধের পর যখন দেবতারা শুম্ভ নিশুম্ভের অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়ে দেবীর স্তব করেছিলেন, সে সময়ে ভগবতী জাহ্নবীজলে স্নান করতে যাওয়ার ছলে, তাঁদের নিকট গিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, তোমরা এখানে কেন ? দেবতারা এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই ভগবতীর শরীর থেকে শিবা অম্বিকা নির্গত হয়ে বললেন,-দৈত্যপত্তি শুম্ভকর্ত্তৃক নিরাকৃত ও তার ভাই নিশুম্ভ কর্তৃক পরাজিত এই দেবতারা একত্র হয়ে আমার স্তব করছে। অম্বিকা ভগবিতীর শরীর-কোষ হতে উৎপন্ন হয়েছেন বলে তিনি কৌষিকী নামে বিখ্যাত হলেন ও হিমাচল আশ্রয় করে রয়েছেন। কৌষিকীর উৎপত্তির পর ভগবতীও নিজ গৌরবর্ণ ত্যাগ করে কৃষ্ণবর্ণ হয়েছিলেন বলে তিনি ‘কালিকা’ নামে বিখ্যাত হলেন এবং তিনিও হিমাচল আশ্রয় করে অবস্থান করতে লাগলেন; এই কালিকার রূপ কি, তা এস্থানে চণ্ডীতে উল্লেখ নেই। তারপরে চণ্ডীতে দ্বিতীয়স্থানে যে কালীমূর্ত্তির কথা আছে, তা এই;- কৌষিকীর হুঙ্কারে শুম্ভের সেনাপতি ধূম্রলোচন ভস্মীভূত হলে, শুম্ভ চগুমুগু নামক দুই প্রচণ্ড সেনাপতিকে বহুসৈন্য সহ কৌষিকীকে আনবার জন্য আদেশ দিলেন। চণ্ডমুণ্ড সৈন্যবল-পরিবৃত হয়ে মহাদৰ্পে দেবীর নিকট হিমাচলে উপস্থিত হলেন। দেবী তাদের দর্প দেখে সামন্য হাসলেন মাত্র। চণ্ডমুণ্ড এসে দেবীকে ধরতে অগ্রসর হল। দৈত্যদ্বয় নিকটে আসামাত্র দেবী মহাক্রোধে তাদের প্রতি তাকালেন। ক্রোধে তাহার মুখমণ্ডল কৃষ্ণবর্ণ হয়ে উঠল এবং তাঁহার ভ্রুকুটি-কুটিল ললাট হতে অতি শীঘ্ৰ এক দেবী নির্গত হয়ে, অসুরদেরকে প্রহার করতে লাগলেন। এই দেবীই কালী। এর রূপ এভাবে চণ্ডীতে উল্লেখ আছে-
“কালী করাল-বদনা বিনিষ্ক্রান্তাসিপাশিনী।
বিচিত্রখট্বাঙ্গধরা নরমালাবিভূষণা ॥
দ্বীপিচর্মপরীধানা শুষ্কমাংসাতিভৈরবা।
অতিবিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণা।
নিমগ্নারক্তনয়না নাদাপূরিতদিঙ্মুখা ॥
কালী, করালবদনা (লম্বিত-মুণ্ড-হস্তা), অসিপাশধারিণী, বিচিত্র থট্বাঙ্গধরা, নরমুণ্ডমালা শোভিতা, ব্যাঘ্ৰ চৰ্ম্ম পরিধানা, শুষ্কমাংসা, অতি ভয়ানক মূৰ্ত্তি, অতি বিস্তৃতমুখমণ্ডল, লোলরসনা, ভীষণা, গাঢ়-রক্তনয়না, হুঙ্কার শব্দে দিগ্মণ্ডল পরিপূর্ণকারিণী। এই কালী যুদ্ধে চণ্ডমুণ্ডকে বিনাশ করে, কৌষিকীর নিকট তাঁদের মুণ্ড দুইটি উপহার দিয়ে বললেন,- আমি চণ্ডমুণ্ড নামক মহাপশু দুটিকে হনন করে এনেছি, এখন যুদ্ধযজ্ঞে শুম্ভ নিশুম্ভকে তুমি নিজে সংহার কর। কৌষিকী হেসে কালীকে বললেন,-চণ্ডমুণ্ডকে বধ করেছ, তারজন্য তোমার নাম চামুণ্ডা বলে বিখ্যাত হবে।
সচরাচর যে কালী বা শ্যামা-মূৰ্ত্তি দেখা যায় তার সাথে এই মূৰ্ত্তির সম্পূর্ণ ঐক্য নেই, কিছুটা সাদৃশ্য আছে।
রক্তবীজবধের সময়ে এই কালী জিহ্বা বিস্তার করে রক্তবীজের শরীর থেকে নির্গত সমস্ত রক্ত ধারণ করে পান করেছিলেন। কৌষিকীর অস্ত্রপ্রহারে রক্তবীজ বিনষ্ট হয়।
চণ্ডীতেও কালীপূজার কোন বিধান নেই। শুম্ভ নিশুম্ভবধের পর দেবী দেবতাদের কে যে পূজাপদ্ধতি বলেছেন; তা শারদীয় মহাপূজার কথা।
দেবীভাগবতের ৫ম স্বন্ধে ২৩শ অধ্যায়ে কৌষিকী উৎপত্তির পর পাৰ্ব্বতীর শরীর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে কালিকা নামে প্রসিদ্ধ হওয়ার কথা আছে; কিন্তু এই কালিকার নাম কালরাত্রি বলেই কথিত হয়। চণ্ডীতে বলা এই কালিকার কোন কার্য্য পাওয়া যায় না, কিন্তু দেবীভাগবতে এর সাথে ধূম্রলোচনের ঘোর সংগ্রাম ঘটেছিল এমন বর্ণন হইয়াছে ও যুদ্ধের পরে এরই হুঙ্কারে ধূম্রলোচন বিনষ্ট হয়। ইনি বরাবর কৌষিকীর পাশে উপস্থিত ছিলেন। দেবীভাগবতেও চণ্ডমুণ্ড বধের সময় কৌষিকীর কপাল হতে ব্যাঘ্ৰচৰ্ম্মাম্বরা, ক্ররা, গজচৰ্ম্মোত্তরীয়া, মুণ্ডমালাধরা, ঘোরা, শুস্কবাপীসমোদরা, খড়গপাশধরা, অতি ভীষণা, খট্ট্বাঙ্গধারিণী, বিস্তীর্ণ-বদন, লোলজিহ্বা কালীর উৎপত্তি কথা আছে। এই কালী চামুণ্ডা নামে বিখ্যাত হন। ইনিই রক্তবীজের রুধিরপায়িনী। এছাড়া অন্যান্য পুরাণেও কালী, ভদ্রকালী, মহাকালী ইত্যাদি নাম পাওয়া যায়, কিন্তু উৎপত্তি সম্বন্ধে বিশেষ কোন বিবরণ পাওয়া যায় না।
কালীমূর্ত্তীর রূপক ভেদ করলে বুঝা যায়, ইহা সৰ্ব্ববিধ্বংসী মহাকালের প্রণয়িনী-অনন্তকালরূপী শিব পদতলে দলিত হয়েছেন, সৰ্ব্বধ্বংসকারিণী শক্তিজ্ঞাপক অসি হন্তে; ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালবাচক ত্রিনয়ন ইত্যাদি।
এস্থানে যতগুলি কালীমূৰ্ত্তির কথা দেওয়া হল, তার কোনটাই শিবারূঢ়া নহে, শবাসনার কথা ‘শ্যামা’ শব্দে দ্রষ্টব্য।
শক্তি পূজায় যে পঞ্চমকার যথা- মদ্য-মাংস-মৎস্য-মুদ্রা-মৈথুন এর কথা পাই তার অর্থ লোকনাথ বসু তাঁর হিন্দুধর্ম মর্ম গ্রন্থে লিখেছেন, পঞ্চ ম কারের প্রথমটি অর্থাৎ মদ কেবল এক পানীয় নয়। তা আসলে ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে ক্ষরিত অমৃতধারা বা সাক্ষাৎ আনন্দ। তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে খুলে যায় মস্তিষ্কের উপরিতল বা ব্রহ্মরন্ধ্র। তখন যে আনন্দধারা প্রবহমান হয়, তাই আসলে মদ্য বা কারণ! আবার সাধকজীবন ও দশমহাবিদ্যা গ্রন্থে তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীর মত, ‘মা মা’ বলতে বলতে যখন ভক্তি নেশার মতো থিতু হবে অন্তরে, তখন সেই মাদকতাকেই বলতে হবে মদ্য!
কালিকা উপনিষদও মদ্য বা কারণবারির এই অন্তর্নিহিত অর্থের দিকেই জোর দিয়েছে। তার নবম শ্লোকে বলা হয়েছে, পঞ্চমকারের বেদসম্মত আধ্যাত্মিক অর্থ বুঝে যিনি দেবীরর পূজা করবেন, তিনিই সতত ভজনশীল, তিনিই ভক্ত। তাঁর প্রচ্ছন্নতা দূর হয়ে মহত্ব প্রকাশিত হয়। তিনি নিরবিচ্ছিন্ন সুখ শান্তি লাভ করে সংসারপাশ থেকে চিরমুক্ত হন। সিদ্ধমন্ত্রজপকারী সাধকের অনিমাদি অষ্টসিদ্ধি লাভ হয়। তিনি জীবন্মুক্ত, সর্বশাস্ত্রবিদ হন। তাঁর হিংসাবৃত্তি বিনষ্ট হওয়ায় তিনি সকল জীবের বিশ্বাসভাজন হন।
কিন্তু, সাধারণ মানুষ মদ্যের এই গূঢ় অর্থ ভুলেছে। বঙ্গে তন্ত্রমতে কালী উপাসনা জনপ্রিয় হওয়ায় একসময় পঞ্চ ম কার-কে কেবল বহিরঙ্গেই ব্যবহার করতে থাকে সুবিধাবাদী শাসকশ্রেণি। সে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের সময়ের কথা। তখন মদ মানে উল্লাস, মাংসে-মৎস্যে ভোজন, মুদ্রা মানে যৌনসুখের আসন এবং মৈথুন বলপূর্বক শরীরসম্ভোগ! শান্ত বাঙালি চৈতন্যদেবের প্রভাবে এবং ইংরেজ শাসনের নৈতিকতার জেরে যৌনাচারের দিকটি পরে এড়িয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু জিভে লেগে রইল মাংস আর মৎস্যের স্বাদ। আর, মাথায় রইল মদের আচ্ছন্নতা। প্রতি বছর কালীপুজোর রাতে যা তুঙ্গে ওঠে। ঠিক বাল্মীকি প্রতিভার ডাকাতরা যা বলেছে- “আজ রাতে ধুম হবে ভারি, নিয়ে আয় কারণ বারি, জ্বেলে দে মশালগুলো, মনের মতন পুজো দেব- নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে!”
কিন্তু, মা কি ভক্তের এই বিস্মৃতিতে আদৌ প্রসন্ন হন?
তথ্যসূত্র- বিশ্বকোষ চতুর্থ খন্ড, দেবদেবীতত্ত্ব সহ পুরাণ ও উপনিষদ।