30> ||যেদিন মা সূক্ষ্ম দেহ লাভ করলেন ||
শরীর যাবার আগের দিন সকাল থেকেই মায়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আমার আবার তার আগের দিন পেট খুব খারাপ হওয়াতে শরীর এত দুর্বল যে নড়বার শক্তি নেই। মহারাজ (শরৎ) আমাকে তাঁর ঘরে বসেই মাছের ঝোলভাত খেয়ে নিতে বললেন।
এদিকে মার শ্বাসকষ্ট এত বাড়ছে যে তাঁর সে কষ্ট যেন চোখে দেখা যায় না। একতলা থেকে তিনতলা - সারাবাড়ি সেই শব্দ শোনা যাচ্ছে। চোখদুটি যেন বেরিয়ে আসছে। মা তো কোনও বাছবিচার করেন নি। যত পাপীতাপীকে বুকে নিয়েছেন বলে তাঁর এই কষ্ট! সাধুভক্তে বাড়ী ভরে গেল।
সারারাত্রি আমি আর সুধীরাদি মায়ের পায়ের কাছটিতে বসেছিলুম। যোগীনমা আমাকে একঘটি জলে মায়ের পায়ের কাছটিতে আঙুল ডুবিয়ে চরণামৃত করে নিতে বললেন। শ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখে ফোঁটা ফোঁটা গঙ্গাজল দিতে লাগলুম। ধীরে ধীরে শব্দ কমে আসতে লাগল, ক্রমে সব শান্ত। তখন রাত একটা বেজে গেছে। সেদিন চৌঠা শ্রাবণ (১৩২৭)।
যে মায়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না, এখন সেই মায়ের রূপ আর ধরছে না - একেবারে দুর্গাপ্রতিমার মতো!
মাকে সরু লালপেড়ে গরদের কাপড় পরিয়ে দেওয়া হলো। পরদিন বেলা এগারটায় মায়ের খাট মাথায় করে কাশীপুর হয়ে বরানগর কুঠিঘাট অবধি নিয়ে আসা হলো। আমাকে গোলাপ-মা, যোগীন-মা সঙ্গে যেতে বারণ করেছিলেন। সুধীরাদি জোর করে আমার হাত ধরে বের করে নিয়ে এলেন। তখন খুব ভগবানের নাম, হরি-সঙ্কীর্তন হচ্ছে। ওদের সঙ্গে সঙ্গে কুঠিঘাট পর্যন্ত গেলুম। সেখান থেকে মহারাজেরা ও ভক্তেরা মাকে নিয়ে একটা বড় নৌকায় উঠলেন। আমরা মেয়েরা পাশে পাশে একটা ছোট নৌকায়।
বেলা দুটোয় বেলুড়ের ঘাটে পৌঁছে মাকে আমতলায় নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর সেখানে পূজা ও ভোগ নিবেদন। পরে গঙ্গার ঘাটে মাকে স্নান করানো হবে। কাপড় দিয়ে আড়াল করা হলো। আমি আর সুধীরা-দি মায়ের শরীর তুলে নিয়ে গঙ্গার জলে রেখে তাঁকে স্নান করালুম। ইদানীং অসহ্য গায়ের জ্বালায় মা প্রায়ই বলতেন, "গঙ্গায় নিয়ে চল, গঙ্গায় নিয়ে চল।" তখন মায়ের শরীর যে কী হালকা ও নরম লাগছিল।
ঐ কাপড়খানা বদল করে তাঁকে আর একটা নতুন সরু লালপেড়ে গরদ পরানো হলো। এবার সাধুরা তাঁকে আবার আমতলায় নিয়ে গেলেন। সেখানে দ্বিতীয়বার মাকে আরতি করা হয়। আমি সব দেখলুম, মনে কিছুই হলো না। তারপর যেখানে বর্তমানে মায়ের মন্দির সেখানে চিতা সাজানো হলো। আমি আর সে দৃশ্য দেখতে পারছি না, কী দেখব? সুধীরা-দির পিছনটিতে শুয়ে পড়লুম।
চন্দনকাঠের চিতায় মাকে শুইয়ে দিয়ে শরৎ মহারাজ ও অন্যসব মহারাজরা বেলপাতা, ধুনো ও গুগগুল প্রদক্ষিণ করে করে আহুতি দিতে লাগলেন।
প্রবোধ-দি জোর করে আমার হাত ধরে টেনে তুলে বললেন, "একবার দেখ না কী সুন্দর দেখাচ্ছে!" দেখলুম আগুনের শিখা আকাশ ছুঁয়ে কত উঁচুতে উঠেছে। তখন তো এখনকার মতো ট্রাম-বাসের সুবিধা ছিল না, তাই খুব বেশী ভিড় হয়নি। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ওপারে তখন বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু এপারে বৃষ্টি নেই।
মায়ের শরীরের কিছুই চোখে পড়ল না, কি জানি কি দেখব ভেবে এতক্ষণ চোখ তুলে তাকাইনি। এখন আমরাও প্রদক্ষিণ করে তিনবার আহুতি দিলুম।
ফিরে...দু-তিন দিন আর উদ্বোধনে যাইনি, মন সরছিল না। ফাঁকা বাড়ি, কী দেখতে যাব? যোগীন-মা ডেকে পাঠালেন। মায়ের ঘর তখনো খালি পড়ে ছিল। সেদিকে আর তাকানো গেল না, কেবলই চোখ ফেটে জল আসছে। যোগীন-মা কাঁদছেন আর বলছেন, "তোরাও যদি না আসবি, আমরা কি করে থাকব? মা চলে গেলেন, সব শূন্য লাগছে।"
[প্রব্রাজিকা ভারতীপ্রাণা বিরচিত শ্রীশ্রীমায়ের চরণপ্রান্তে থেকে নিবেদিত]
(সংগ্রহীত)
<--আদ্যনাথ-->
==========================
No comments:
Post a Comment