Tuesday, November 9, 2021

29>|| ভূত চতুর্দশী' ও কিছু কথা :-

 29>||-: 'ভূত চতুর্দশী' ও কিছু কথা :- 

কার্ত্তিকমাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি 'ভূত চতুর্দশী' নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে কালীপুজো ও ভ্রাতৃদ্বিতীয়া এসবের পাশাপাশি ধনতেরস্ (ত্রয়োদশী তিথি), ছট্ পূজা, ভূত চতুর্দশীও পালনীয় দিন হিসেবে গণ্য হয়েছে।

    দীপাবলির যে পাঁচদিন মুখ্যতঃ উৎসব পালিত হয়, তার প্রথম দিনটি ধনতেরস্, দ্বিতীয় দিন ভূত চতুর্দশী এবং এরপরের দিনই দীপাবলির মুখ্য উৎসবটি হয়ে থাকে। কথিত আছে, বিজয়া দশমীর দিন শ্রীরাম লঙ্কাবিজয় করার পর কার্ত্তিকমাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে অযোধ্যায় ফিরে এসেছিলেন। তাই মহানন্দবশতঃ অযোধ্যাবাসী তাদের প্রিয় রাজকুমারের ফিরে আসার আনন্দে এই দিনটিতে সারা অযোধ্যাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করেছিলেন। সেই থেকেই এই দিনে 'দীপাবলি-উৎসব' শুরু। এই দিন পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র কালীপূজা হয়। কিন্তু, দীপাবলির সাথে কালীপূজার সম্পর্ক নেই। যেহেতু সেইদিনই অমাবস্যা থাকে, তাই অমাবস্যায় কালীপূজা হয়। 

যাই হোক, ফিরে আসা যাক মূল প্রসঙ্গে।

              হিন্দুধর্মের প্রতিটি উৎসবেরই অনেক গূঢ়তর মাহাত্ম্য থাকে, 'ভূত চতুর্দশী'- এই দিনটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এই দিনের মাহাত্ম্যও অনেক বেশি। "মূলতঃ অশুভ শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে মনোবলকে দৃঢ় রেখে লড়াইপূর্বক  শুভশক্তির জাগরণ তথা বিজয় ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা"- এটি ভূত চতুর্দশীর মূল গূঢ়-মাহাত্ম্য। 

     'ভূত চতুর্দশী' নামের দ্বারাই বোঝা যায়, ভূত,প্রেত, আত্মা, কালো জাদুবিদ্যা ইত্যাদির সাথে দিনটি ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। ভূত চতুর্দশীর রাতেই প্রত্যেক পরিবারের ১৪ টি মৃত পূর্বপুরুষের আত্মাগণ তাদের  নিজেদের  জীবিত উত্তরপুরুষ-বংশধরদের সাথে দেখা করতে আসেন। এছাড়াও বিভিন্ন আত্মারা তাদের প্রিয় ব্যক্তিদেরও দেখতে আসেন, এটাও মান্যতা।

            আসলে 'ভূত' বলতে 'যা অতীত'-এই অর্থও বোঝানো হয়। তাই আমাদের অতীত পুরুষগণ অর্থাৎ আমাদের গত পূর্বপুরুষকেও সেদিন আমরা স্মরণ করি এবং তাদের উদ্দেশ্যে সারা বাড়িতে ১৪ টি মাটির প্রদীপ   জ্বালিয়ে ঈশ্বর ও আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে থাকি। ভূত চতুর্দশীর রাতটিতে আসুরিক তথা ঋণাত্মক শক্তিসমূহ অধিক শক্তিশালী হয়। তাই আসুরিক শক্তি তথা ঋণাত্মক আত্মাদের দূরে রাখতেও সারা বাড়ি প্রদীপের আলোয় আলোকিত করা হয়। এছাড়া 'চতুর্দশী তিথি'-টি হল কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশতম দিন, তাই এই 'চতুর্দশপ্রদীপ প্রজ্বলন' তার তাৎপর্য্যও বহন করে। তেল বা ঘি দ্বারা মাটির প্রদীপ জ্বালালে তা মানব শরীরের পক্ষে উপকারী এবং তার দ্বারা গৃহে প্রবাহিত বায়ু পরিশোধিত হয়ে জীবানুমুক্ত হয়- এর বৈজ্ঞানিক সত্যতাও রয়েছে।

'রূপচতুর্দশী' নামেও এই দিনটিকে জানা যায়। এই নামটি মৃত্যুর দেবতা যমরাজের সাথে সম্পর্কিত। এই দিন সন্ধ্যায় যমরাজের জন্যও বহু বাড়িতে বাড়ির দক্ষিণদিকে একটি প্রদীপ জ্বালানো হয়ে থাকে। বলা হয়, এই দিন যমরাজের উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলে নরকের ভয় বা অকালমৃত্যুর ভয় কাটে।

পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার পাশাপাশি ভূত চতুর্দশীতে ভেষজগুণযুক্ত ১৪ টি শাকমিশ্রিত ব্যঞ্জন খাওয়া হয়ে থাকে, যা বিশেষ পুষ্টিযুক্ত। আসলে এটি শীতের প্রারম্ভে আমাদের শরীরের জন্য বিশেষ রোগ-প্রতিরোধকের কাজ করে থাকে। অনেকের মতে, ভূত চতুর্দশীর আগের দিন অর্থাৎ 'ধনতেরস্' (ত্রয়োদশী তিথি) হলো 'ধন্বন্তরী' নামক আয়ুর্বেদজ্ঞ-এর জন্মতিথি, যিনি কাশীর রাজা ছিলেন। তাঁর জন্মতিথি ত্রয়োদশী তিথির একেবারে শেষ লগ্নে, চতুর্দশীর শুরুতেই। তাই তাঁকে সন্মান জানিয়েই ও আয়ুর্বেদকে স্মরণ করেই ১৪ টি শাকমিশ্রিত ব্যঞ্জন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খাওয়া হয়ে থাকে, শীতকালের প্রারম্ভের পরিবর্তিত আবহাওয়া থেকে  সুস্থ থাকবার জন্যই। তাই এই ত্রয়োদশী দিনটিকে তাঁর নামানুসারেই 'ধন্বন্তরী তেরস্' বা 'ধন্তেরস্' বলা হয়। এছাড়াও এই দিনের সাথে ধন ক্রয় বা লাভেরও একটি সম্পর্ক আছে। যদিও অনেকের বিশ্বাস, এই দিনে সোনা-রূপা ইত্যাদি ক্রয় বা লাভ করলে অথবা মহালক্ষ্মী পুজো বা কুবেরের পুজো করলে গৃহস্থের ধন-ঐশ্বর্য্য ও শ্রী বৃদ্ধি হয়। তাই এই ত্রয়োদশী দিনটিকে হিন্দিতে 'ধনতেরস্' নামেও অভিহিত করা হয়। তাই দেশের বিবিধ প্রান্তের (বিশেষতঃ উত্তরভারত ) বহু মানুষ এই দিনে সোনা, রূপা ইত্যাদি ধনসম্পদ ক্রয় করে থাকেন এবং বিবিধ পূজাপাঠও করে থাকেন। 

 পুরাণ মতে, ভূত-চতুর্দশীর দিনই শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করেন। তাই এই দিনটি 'নরক চতুর্দশী' নামেও খ্যাত। নরকাসুর ষোলো হাজার একশোজন কন্যাকে বন্দিনী করে রেখেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ মাকালীর সহায়তায় নরকাসুরকে বধ করে তাদের মুক্ত করেন। এই কন্যাদের পিতা-স্বামীরা তাদের আর নিজের করে মেনে না নিলে, তারা লোকলজ্জায় আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন শ্রীকৃষ্ণ সকলকে পত্নীরূপে বরণ করে তাদের যোগ্য সন্মান দিয়েছিলেন। 

  আবার, মা চামুণ্ডা এই দিনেই প্রবল হওয়া আসুরিক শক্তি ও ঋণাত্মক প্রেত-আত্মাদের দূরীভূত করে থাকেন মহাকালীরূপে। এছাড়া, বছরের অন্যান্য কৃষ্ণচতুর্দশীর থেকে এই চতুর্দশী বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। তাই একে 'কালীচতুর্দশী' -ও বলা হয়। এই নামটি মাকালীর মহত্ব বা কালোতম দিন- এই দুই অর্থেই হয়ে থাকতে পারে বলেই মনে হচ্ছে।

  তাছাড়া, দিবালীর আগের দিনই যেহেতু অনেকে এই দিনেও প্রদীপ জ্বালায়, বাজি পোড়ায়, তাই দেশের কোনো কোনো জায়গায় (মূলতঃ উত্তরভারতে) একে 'ছোটী দিবালী'-ও বলে।

  গ্রামের দিকে এই দিনটিতে খুবই সাবধানে সকলে বাড়ির ভিতরেই বসবাস করেন, মনে একটি মৃদু ভয় রেখে। কারন মান্যতা আছে, এইদিন সমস্ত ঋণাত্মক শক্তি জাগরিত হয়। তান্ত্রিক সিদ্ধিও এই দিনেই অধিক ফলপ্রসূ হয়ে থাকে, এই দিন তাই দেবী কালীর পুজো করে তাতে নরবলির প্রথা এক সময় ছিল, তান্ত্রিক সিদ্ধিকে সফল করবার জন্য। প্রত্যন্ত গ্রামে বহু পূর্বে শিশুদের এই সিদ্ধিলাভের আশায় বলিপ্রদান করা হতো। নরবলির মধ্যে শিশুবলি উৎকৃষ্ট - এই অন্ধবিশ্বাস ছিল। তাই প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে শিশুদের এই দিন বাড়িতেই রাখা হতো, বেরোতে দেওয়া হতো না। যাই হোক, এই ক্রূরতম অন্ধবিশ্বাস আপাতত প্রশাসন বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে, আগামীতেও এটি বন্ধ থাকুক এই বিষয়ে তারা তৎপর। প্রশাসনের চাপে এখন নরবলি বন্ধ হওয়ায় তা ছাগবলির মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। এর দ্বারা মনস্কামনা পূরণ হয় এটি সিদ্ধতান্ত্রিকদের মত। কালোজাদুবিদ্যাও এই দিনেই অধিক প্রয়োগ করা হয়ে থাকে বলেও মত । 

  বহু শ্মশানে ও গৃহস্থে এইদিন কালীপুজোও হয়ে থাকে। মাকালীকে সুগন্ধজাতীয় দ্রব্য (যেমন- চন্দন,পুষ্প ইত্যাদি) দিয়ে পূজা দিলে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হওয়া যায়। সকল প্রকার বিঘ্নসমূহকেই বিনাশ বা দূরীভূত করে শুভ শক্তির প্রকাশের আশায় মাতৃশক্তির আরাধনা করা হয়। এই দিন দেবীর পূজার মাধ্যমে মনের আলস্য, ঈর্ষা, দ্বেষ, মোহ ইত্যাদি সকল প্রকার ঋণাত্মক ভাব ত্যাগ করে মনে ভক্তিভাব আনার চেষ্টা করা হয়ে থাকে।


🌺🙏🌺🙏🌺🙏🌺🙏🌺

No comments:

Post a Comment