গৌতম বুদ্ধের চতুরার্য সত্য::--
বৌদ্ধ চিন্তার মৌলিক কাঠামো
চতুরার্য সত্য
(সংস্কৃত: चत्वारि आर्यसत्यानि/চত্বারি আর্যসত্যানি)
গৌতম বুদ্ধ দ্বারা প্রচারিত চারটি শ্রেষ্ঠ সত্য এবং তার প্রধান জ্ঞান দর্শন। এই চারটি সত্য হল
★1>দুঃখ,
★2>দুঃখ সমুদয়,
★3>দুঃখ নিরোধ ও
★4>দুঃখ নিরোধ মার্গ।
চতুরার্য সত্য তত্ত্বে দুঃখ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
★1>দুঃখ (বৌদ্ধ ধর্ম)::--
চতুরার্য সত্যের প্রথম সত্য হল দুঃখ। গৌতম বুদ্ধের মতে পঞ্চ উপাদান যখন ব্যক্তির তৃষ্ণার বিষয় হয়ে তার নিকটে প্রকট হয়, তখন তাকে উপাদান স্কন্ধ বলে।
এই পঞ্চ উপাদান স্কন্ধকে তিনি দুঃখ বলেছেন। এই পঞ্চ উপাদান হল
●রূপ, ●বেদনা, ●সংজ্ঞা, ●সংস্কার ও ●বিজ্ঞান।
●ক্ষিতি, ●অপ্, ●তেজ, ●মরুৎ এই চার মহা উপাদান হল রূপ উপাদান। বস্তু ও তার বিচার সম্বন্ধে অনুভব হল বেদনা উপাদান। বেদনার পর যে পূর্ব সংস্কার দ্বারা ব্যক্তি বা বস্তুকে চেনা যায় তা হল সংজ্ঞা উপাদান। রূপ, বেদনা ও সংজ্ঞা দ্বারা চিন্তায় প্রকৃত ব্যক্তি ও বস্তুকে চিনতে সাহায্য করে সংস্কার উপাদান এবং চেতনা বা মনকে বলে বিজ্ঞান।
দুঃখকে মূলতঃ তিনভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা:
■ দুঃখ দুঃখ - ●জন্ম, ●জরা, ●ব্যাধি এবং
●মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত দৈহিক ও
মানসক কষ্ট,
■ বিপরিণাম দুঃখ - পরিবর্তনশীল
বিষয়কে স্থির রাখার দুশ্চিন্তা,
■ সংস্কার দুঃখ - মানসিক চাহিদা
পরিপূরণের অভাববোধ।
বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখ জীবনের নিরাশাবাদী তত্ত্বকে দর্শায় না, বরং মানবজাতির প্রতিটি সদস্যকে জীবনের কোন না কোন মুহুর্তে জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুর যন্ত্রণার অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবেই, মানব অবস্থার এই প্রায়োগিক ও বাস্তব পরীক্ষাকে নির্দেশ করে।
গৌতম বুদ্ধের মতে জীবনে সুখ ও দুঃখ দুই অবস্থান করে, কিন্তু তা সদা পরিবর্তনশীল।
সুখ ও দুঃখ কোনটিই বেশিদিন স্থায়ী নয়। সেই কারণে পরিবর্তনশীল সমাজে চাহিদার পূরণ সম্ভব হয় না।
___________=========__________
★2>দুঃখ সমুদয়::---
দুঃখ সমুদয়
চতুরার্য সত্যের দ্বিতীয় সত্য হল দুঃখ সমুদয় বা দুঃখের কারণ। গৌতম বুদ্ধ দুঃখের হেতু বা কারণ হিসেবে তৃষ্ণা বা আসক্তিকে উল্লেখ করেছেন।
অবিদ্যার কারণে বিশ্বের সকল প্রকারের ইন্দ্রিয়প্রিয় বস্তু বা বিষয়ের ওপর চিন্তা ও সম্বন্ধ স্থাপনে তৃষ্ণার জন্ম দেয়।
এই তৃষ্ণা তিন প্রকার:
সম্ভোগতৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা,বৈভবতৃষ্ণা।
সম্ভোগতৃষ্ণা : যে বস্তু পার্থিব আনন্দ প্রদান করে, তার ওপর তৃষ্ণা।
ভবতৃষ্ণা : পার্থিব সম্মান ও প্রভাব বিস্তারের ওপর তৃষ্ণা।
বৈভবতৃষ্ণা : দুঃখ কষ্টের প্রতি বিতৃষ্ণা
চতুরার্য সত্যের অর্থ ও তাত্পর্য্যকে না জানা ও নিজেকে ও বাস্তবকে না বোঝাকে অবিদ্যা বলা হয়ে থাকে। অবিদ্যার কারণে ক্লেশের উদ্ভব হয়ে থাকে।
এই সূত্রে দুঃখের মূল কারণ রূপে ত্রিবিষের উল্লেখ করা যায়।
এই তিনটি বিষ হল- অবিদ্যা বা মোহ, রাগ এবং দ্বেষ।
__________=========________
★3>দুঃখ নিরোধ::--
নিরোধ::--
গৌতম বুদ্ধের সকল দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। তৃষ্ণাকে দৃঢ় ভাবে সংযত করে ও ক্রমশ পরিত্যাগ করে বিনাশ করাকে গৌতম বুদ্ধ দুঃখ নিরোধ বলেছেন।
প্রিয় বিষয়ে তত্ত্ব নির্ণয়ে সংশয় থেকে যখন তৃষ্ণা বিমুখ হয়, তখন তৃষ্ণা নাশ সম্ভব এবং তার ফলে বিষয় সংগ্রহের প্রবণতা নষ্ট হয়।
উপাদানের নিরোধে ভবলোকের নিরোধ হয়। ফলে বার্ধক্য, মৃত্যু, শোক, ক্রন্দন, ক্লেশ ও জটিলতা দূরীভূত হয়ে দুঃখের নিরোধ হয়।
_____________==========_________
★4>দুঃখ নিরোধ মার্গ::---
(অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রতীক ধর্ম চক্র):
অষ্টাঙ্গিক মার্গ--
যেখানে চতুরার্য সত্যের প্রথম তিনটি সত্য দুঃখের বৈশিষ্ট্য ও কারণকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, সেখানে এর চতুর্থ সত্য দুঃখ নিবারণের ব্যবহারিক উপায় দর্শায়।
গৌতম বুদ্ধ দ্বারা বর্ণিত দুঃখ-নিরোধ মার্গ বা দুঃখ নিরসনের উপায়কে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। এর আটটি উপদেশকে
তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
●সম্যক প্রজ্ঞা,
●সম্যক শীল ও
●সম্যক সমাধি
●সম্যক প্রজ্ঞা দুই প্রকার- *সম্যক দৃষ্টি ও *সম্যক সঙ্কল্প।
কায়িক, বাচনিক ও মানসিক কর্মের সঠিক জ্ঞানকে সম্যক দৃষ্টি বলে। অহিংসা, চুরি না করা, অব্যভিচার ও সত্যভাষণ হল কায়িক সুকর্ম, নিন্দা না করা, মধুর ভাষণ ও লোভহীনতা হল বাচনিক সুকর্ম এবং মিথ্যা ধারণা না করা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ না হওয়া হল মানসিক সুকর্ম।
●সম্যক শীল তিন প্রকার- সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম ও সম্যক জীবিকা।
মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, কটুবাক্য ও অতিকথন ত্যাগ করে সত্যভাষণ ও মধুর বচনকে সম্যক বাক্য বলে।
অহিংসা, চুরি না করা, অব্যভিচারকে সম্যক কর্ম বলে।
এবং অসৎ পন্থা ত্যাগকে সম্যক জীবিকা বলে।
গৌতম বুদ্ধ অস্ত্র ব্যবসা, প্রাণী ব্যবসা, মাংস বিক্রয় এবং মদ ও বিষের বাণিজ্যকে মিথ্যা জীবিকা বলে উল্লেখ করেছেন।
●সম্যক সমাধি তিন প্রকার- •সম্যক প্রযত্ন, •সম্যক স্মৃতি ও •সম্যক সমাধি।
ব্যায়াম, ইন্দ্রিয় সংযম, কুচিন্তা ত্যাগ এবং সৎ চিন্তার চেষ্টা ও তাকে স্থায়ী করার চেষ্টাকে সম্যক প্রযত্ন বলে।
কায়া, বেদনা, চিত্ত ও মনের ধর্মের সঠিক স্থিতিসমূহ ও তাদের ক্ষণবিধ্বংসী চরিত্রকে সদা স্মরণে রাখাকে সম্যক স্মৃতি
বলে।
এবং চিত্তের একাগ্রতাকে সম্যক সমাধি বলে।
৻৻★এই আটটি মার্গ একত্রে দুঃখের অবসান ঘটায়।
এই মার্গগুলি আটটি বিভিন্ন দশা নয়, বরং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল পরস্পর সংযুক্ত হয়ে একটি সম্পূর্ণ পথের সৃষ্টি করে।
★★বারো অন্তর্দৃষ্টি::--
বুদ্ধের প্রথম বার্তা, দ্বিতীয় শতাব্দী (কুষাণ যুগ)
ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র অনুসারে চতুরার্য সত্যকে ঠিক মতো বুঝতে প্রতিটি সত্যের জন্য তিনটি করে ধাপে মোট বারোটি অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন। বৌদ্ধধর্মে এই তিনটি ধাপ সম্বন্ধে বলা হলেও কয়েকজন মহাযান পণ্ডিতের রচনাতেও এর উল্লেখ আছে। এই তিনটি ধাপ হল:
●সচ্চ নান - সত্য সম্বন্ধে জানা
●কিচ্চ নান - সত্য সম্বন্ধে কি করতে হবে তা জানা
●কত নান - যা করতে হবে তা সম্পন্ন করা।
■ প্রথম সত্যের তিনটি অন্তর্দৃষ্টি
*দুঃখ আছে
*দুঃখকে উপলব্ধি করতে হবে।
*দুঃখকে উপলব্ধি করা হল।
■ দ্বিতীয় সত্যের তিনটি অন্তর্দৃষ্টি
*দুঃখের কারণ আছে যা তৃষ্ণার সাথে সম্পর্কযুক্ত
*তৃষ্ণাকে দূর করতে হবে
*তৃষ্ণাকে দূর করা হল।
■ তৃতীয় সত্যের তিনটি অন্তর্দৃষ্টি
*দুঃখের নিবৃত্তি আছে
*দুঃখের নিবৃত্তি হয় তা উপলব্ধি করতে হবে।
*দুঃখের নিবৃত্তি হয় তা উপলব্ধি করা হল।
■ চতুর্থ সত্যের তিনটি অন্তর্দৃষ্টি
*দুঃখ নিবৃত্তির উপায় আছে।
*দুঃখ নিবৃত্তির উপায় জানতে হবে,
*দুঃখ নিবৃত্তির উপায় উপলব্ধি করা হল।
★★বুদ্ধের দর্শন::---
চতুরার্য সত্যকে বুদ্ধের প্রধান শিক্ষা বলে ধরা হয়। এই শিক্ষা সমস্ত বৌদ্ধ চিন্তাধারার মূল কাঠামো ও
মিলনক্ষেত্ররূপে বিবেচিত হয়।
গৌতম বুদ্ধের মতে, যেভাবে কোন হাতির পদচিহ্নে যে কোন পশুর পদচিহ্ন স্থান পেয়ে যায়, ঠিক তেমন করে এই বুদ্ধের সমস্ত শিক্ষা এই চার সত্যে স্থান পায়।
সারা জীবন ধরে গৌতম বুদ্ধ চার সত্যের শিক্ষাকে বারবার পরিবর্ধন করে তাঁর শিষ্যদের শিক্ষা দিয়েছেন।
গৌতম বুদ্ধ নিজের জীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে চতুরার্য সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন। বৌদ্ধ পণ্ডিত রুপার্ট গেথিন ও থানিসসারো ভিক্ষু এই ধারণার উল্লেখ করেছেন।
■■■ বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ::----
গৌতম বুদ্ধ সারা জীবন ধরে চতুরার্য সত্যকে প্রচার করায় বহু বৌদ্ধ সূত্রে এই তত্ত্বের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র অনুসারে সম্বোধিলাভের পর গৌতম বুদ্ধ সর্বপ্রথম চতুরার্য সত্যের শিক্ষা দান করেন। এই সূত্রে চারটি মূল শ্লোকে চারটি তথ্যকে উপস্থাপিত করা হয়েছে।
গ্রন্থানুসারে বারো নিদানের ওপর নির্ভর করে দুঃখের কারণ ও নিরোধ হয়ে থাকে।
এছাড়াও বুদ্ধের জীবনের অন্তিম পর্যায়ে রচিত মহাপরিনিব্বাণ সুত্তে চতুরার্য সত্য সম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া রয়েছে।
(সংগৃহীত)
==========================
"""""""""""""
No comments:
Post a Comment