Tuesday, November 1, 2022

39>कराग्रे वसते लक्ष्मीः---क्यों देखते हैं सुबह अपनी हथेलियां::---


39>कराग्रे वसते लक्ष्मीः--क्यों देखते हैं सुबह अपनी हथेलियां::---

दिन का शुभ आरंभ शुभ चीजों को देखने से होता है। इसके लिए भारतीय ऋषि-मुनियों ने हमें करदर्शनम यानी हाथों के दर्शन का संस्कार दिया है।

शास्त्रों में भी जागते ही बिस्तर पर सबसे पहले बैठकर दोनों हाथों की हथेलियों (करतल) के दर्शन का विधान बताया गया है। इससे व्यक्ति की दशा सुधरती है और सौभाग्य में वृद्धि होती है।

जब आप सुबह नींद से जागें तो अपनी हथेलियों को आपस में मिलाकर पुस्तक की तरह खोल लें और यह श्लोक पढ़ते हुए हथेलियों का दर्शन करें-

कराग्रे वसते लक्ष्मीः करमध्ये सरस्वती ।

करमूले तु गोविन्दः प्रभाते करदर्शनम ॥

अर्थात मेरे हाथ के अग्रभाग में भगवती लक्ष्मी का निवास है। मध्य भाग में विद्यादात्री सरस्वती और मूल भाग में भगवान विष्णु का निवास है। अतः प्रभातकाल में मैं इनका दर्शन करता हूं। इस श्लोक में धन की देवी लक्ष्मी, विद्या की देवी सरस्वती और अपार शक्ति के दाता, सृष्टि के पालनहार भगवान विष्णु की स्तुति की गई है, ताकि जीवन में धन, विद्या और भगवत कृपा की प्राप्ति हो सके।

हथेलियों के दर्शन का मूल भाव यही है कि हम अपने कर्म पर विश्वास करें। हम ईश्वर से प्रार्थना करते हैं कि ऐसे कर्म करें जिससे जीवन में धन, सुख और ज्ञान प्राप्त कर सकें। हमारे हाथों से कोई बुरा काम न हो एवं दूसरों की मदद के लिए हमेशा हाथ आगे बढ़ें।

कर दर्शन का दूसरा पहलू यह भी है कि हमारी वृतियां भगवत चिंतन की ओर प्रवृत हों ऐसा करने से शुद्ध सात्विक कार्य करने की प्रेरणा मिलती हैं, साथ ही पराश्रित न रहकर अपनी मेहनत से जीविका कमाने की भावना भी पैदा होती है।

आंखें भी रहेंगी स्वस्थ-जब हम सुबह सोकर उठते है तो हमारी आंखें उनींदी रहती हैं। ऐसे में यदि एकदम दूर की वस्तु या कहीं रोशनी पर हमारी नज़र पड़ेगी तो आंखों पर कुप्रभाव पड़ेगा। कर दर्शन करने का यह फायदा है कि इससे दृष्टि धीरे-धीरे स्थिर हो जाती है और आंखों पर कोई दुष्प्रभाव नहीं पड़ता।

विश्वास से मिलता हैं सब कुछ

तर्क से नेही मिलता कुछ

विश्वास में विष भी है और आस भी है, ये स्वयं पर निर्भर करता है की क्या ग्रहण करना हैं।

 <------आद्यनाथ राय चौधरी----->

==========================




Monday, September 12, 2022

38> || ক্ষণ-চর ||(সংগ্রহীত)

     38> || ক্ষণ-চর  ||


অতি চঞ্চল ও দেখতে সুন্দর এমন এক মানুষ এক  ট্রেন থেকে নামলো, কিন্তু তাকে আবার আরেক ট্রেনে উঠতে হবে একটু পরে, বোধ হয় 20 মিনিট পরেই আসবে পরবর্তী ট্রেন । সেই কারণে মাঝখানে সে অপেক্ষা করার জন্য ওয়েটিং রুমে ঢুকলো। 

ওয়েটিং রুমে ঢুকেই তার চোখ পড়ল রুমের লাইট টি নষ্ট। তাই সে একটি এনার্জি বাল্ব কিনে লাগালো। তারপর খেয়াল করলো রুমের ফ্লোরে ময়লা, তাই একটি ঝাড়ু কিনলো, এবং সে রুমটি ঝাড়ু দিলো। তারপর সে খেয়াল করলো রুমের বসার চেয়ারগুলো বেশি একটা আরাম দায়ক নয়, তাই সে একটি আরাম দায়ক চেয়ার কিনলো। এখন সে রুমটি সাজানোর জন্য কিছু জিনিস কিনে রুমটি সাজালো।

এখন সে অনেক ক্লান্ত হয়ে গেল, তাই একটু বিশ্রাম দরকার  এবং তার  আরাম দায়ক চেয়ারে বসতে যাচ্ছে এই মূহুর্তে হঠাৎ করেই ট্রেনের হর্ন শুনতে পেল এবং সে ট্রেনে উঠার জন্য রুম থেকে চলে গেল এবং ট্রেনে বসে তার গন্তব্য স্থানে চলে গেল.......আপনি ভাবছেন এই লোকের চেয়ে বোকা লোক আর পৃথিবীতে নেই।  

কিন্ত আপনি কি জানেন এই লোকটি কে?

এই লোক টি আর কেউ নয়  

আপনি - আমি!!!

অবাক হলে ও এটাই সত্য আমরাও পৃথিবীতে এসেছি সামান্য সময়ের জন্য। 

এখানে,,

১ম ট্রেন আমাদের জন্ম....

২য় ট্রেন  আমাদের মৃত্যু এবং আমাদের গন্তব্য  ( স্বর্গ  অথবা নরক )।। 

আর জগতের  জীবন  হচ্ছে ওয়েটিং রুম।।

যেখানে আমরা মাত্র  কিছু সময়  থাকবো। 

অথচ এই পৃথিবীর  জীবনকেই এমন ভাবে সাজাচ্ছি। 

যে আমরা ভুলেই গেছি আমাদের মৃত্যু খুব সন্নিকটে এবং আমাদের এই সাজানো গোছানো  দুনিয়ার সব কিছু ছেড়ে মৃত্যু নামক ট্রেনে চড়ে চলে যেতে হবে।

আমরা এই ওয়েটিং রুমটি সাজিয়ে কয় মিনিট ভোগ করতে পারবো.........!!! 

ঈশ্বর  আমাদের সবাইকে জগতের মোহ কাটিয়ে স্বর্গরাজ্যে যাওয়ার  খোরাক যোগাড় করার মনমানসিকতা দান করুন ..

       "সংগ্রহীত"

    <---আদ্যনাথ রায় চৌধুরী--->

==========================


Saturday, September 3, 2022

37>|| ভগবান ভালবাসার কাঙাল ||(সংগ্রহীত)

   37>|| ভগবান ভালবাসার কাঙাল ||


"দ্বাপর যুগের শেষ লগ্ন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হবে। চারিদিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। এমন সময়ে দেবর্ষি নারদ শ্রীকৃষ্ণের কাছে এসে বললেন, "প্রভু সবাই বলছে, আপনি পান্ডবদের পক্ষ গ্রহন করে, কৌরবদের সাথে পক্ষপাতীত্ব করছেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হাসলেন, কিছু বললেন না। তিনটি মালা নিয়ে দেবর্ষি নারদের হাতে দিলেন। বললেন, "দুই পক্ষে যাবে এই মালা তিন জনকে পরাবে। কাকে পরাবে? একটা পরাবে উত্তম জনকে, একটা মধ্যম জনকে আর একটা অধম জনকে।"

দেবর্ষি নারদ মালা তিনটি নিয়ে কৌরবদের কাছে আসলেন ও মালার কথা বললেন। দুর্যোধন সভায় বললেন, "আমি উত্তম, আমার ভাই দুঃশাসন মধ্যম। আর অধম সভায় যে কেউ হতে পারে।"

"কিন্তু কেউ অধম হতে চাইলো না। তখন রাস্তা থেকে এক জেলেকে ডাকা হলো, অধম স্বীকার করে মালা নিতে। জেলে বলল, "ছোট আছি ছোট থাকবো কিন্তু হীন হতে পারবো না।"

"তিন জনকে না পাওয়ায় দুর্যোধন মালা পেল না। এবার দেবর্ষি নারদ যুধিষ্ঠিরের সভায় গেলেন। মালার কথা ও তিন জনের কথা বলতেই যুধিষ্ঠির বললেন, "দেবর্ষি, পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঐ আসনে বসেন। উত্তম মালা ওখানে থাকুক। মধ্যম মালাটা আপনার। কারণ আপনি ভক্তশ্রেষ্ঠ। আর অধম তো আপনার সমানে আমি যুধিষ্ঠির অধম।"

"দেবর্ষি নারদ ভগবানের কাছে ফিরে এলেন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, "ওখানে দুর্যোধন প্রধান। আমার স্থান নেই। যুধিষ্ঠিরের ওখানে আমার স্থান পাতা আছে। আমি আর কোথায় যাবো, এবার তুমিই বলো? তাই পান্ডবের সাথে আছি। ওরা আমাকে বড় ভালবাসে।"


"ভগবান ভালবাসার কাঙ্গাল। ভালবাসা ছাড়া আর কিছু চাই না ভগবানের। ভালবাসাতে মা যশোদার কাছে বাঁধা। ভালবাসাতে গোপীদের কাছে  ঘুরে ফিরে বার বার যান। ভালবাসাতে চিরদিন বাঁধা ভগবান। আর এই  একনিষ্ঠ ভালবাসাই হলো শুদ্ধ ভগবদ্ ভক্তি"।

          ( সংগ্রহীত)

    <-----আদ্যনাথ রায় চৌধুরী---->

============================


Friday, September 2, 2022

36>|| ভগিনী ঋণ=জগদীশচন্দ্র বসু ও নিবেদিতা || ||

  36>||  ভগিনী ঋণ=জগদীশচন্দ্র বসু ও নিবেদিতা ||


এক অজানা কাহিনী৷   

"ভগিনী ঋণ" ও একজন বিজ্ঞানীর চোখে জল! 

 ১৯০০ এর শেষের দিকে  প্যারিসে জগদীশ চন্দ্র বসুর  বিজ্ঞান কংগ্রেসে পেপার পড়তে যাওয়ার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার চরম বিরোধিতা করেছিল।

 একমাত্র  নিবেদিতার চেষ্টায় জগদীশ  বোস গেলেন সেই বিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগদান করতে।

এ কাজে নিবেদিতাকে  সহায়তা করেছিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত মানুষ  প্যাট্রিক গেডেস। 

 এই সেই প্যাট্রিক গেডেস যিনি জগদীশ চন্দ্র  বসুর  জীবনী লিখেছিলেন।


প্যারিসের বিজ্ঞান কংগ্রেস ছিল জগদীশ বসুর জীবনে একটা  টার্নিং পয়েন্ট। 

এখান থেকেই  সারা বিশ্বে তাঁর নাম ছড়িয়ে গেল।

সেই সম্মেলনে ভাষণ শুনতে স্বামী বিবেকানন্দ  ও নিবেদিতা দুজনেই সেদিন উপস্থিত ছিলেন। 


স্বামী বিবেকানন্দ সেই ভাষণের  বিবরণ দিয়েছেন তাঁর লেখায়,

"... এক যুবা যশস্বী বীর আমাদের মাতৃভূমির নাম ঘোষণা করলেন, সে - জগৎ প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক

জে সি বোস...ভারতবাসী,বঙ্গবাসী, ধন্য বীর!" 

 (তথ্য সূত্র,   স্বামীজির বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খন্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, পৃ: ৯৭)


১৯০২ সালে অক্টোবর মাসে   একটি বই প্রকাশ হওয়া মাত্রই বিশ্বে আলোড়ন পড়ে গেল।

বইটির নাম হল, "রেসপন্স ইন দ্য লিভিং এ্যান্ড নন লিভিং।"

এই সেই গবেষণামূলক বই যার মাধ্যমে জে সি বোস দেখিয়েছিলেন উদ্ভিদের প্রাণ আছে।

আরো দুটি বই, " প্ল্যান্ট রেসপন্স এবং "কম্পারেটিভ ইলেকট্রোফিজিওলজি।"

এই বইগুলির পান্ডুলিপি পরিমার্জন, সম্পাদনা প্রভৃতি যাবতীয় কাজ নিবেদিতা একা করেছিলেন।

বইগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর  জগদীশ বসুর গবেষণার বিষয় ছড়িয়ে গেল।

অবশ্যই বিজ্ঞানের মূল বিষয়টা ছিল  জে সি বোসের। 

কিন্তু বাকি কাজগুলো সব নিবেদিতা একা করেছিলেন।


জগদীশ বসুকে বিশ্বমাঝারে পরিচিত করার ক্ষেত্রে নিবেদিতা একটি স্মরণীয় অবদান রেখে গেলেন। 

 এ কাজ তিনি করেছিলেন  ভারতবর্ষকে  ভালবেসে। 


নিবেদিতা আর একটি অসাধারণ কাজ করেছিলেন।

নিবেদিতা জগদীশ বসুর "বোস ইন্সটিটিউট" গড়ে তুলতে  অর্থের  ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

নিবেদিতাই  সারা বুলকে রাজী করিয়েছিলেন অর্থ দেওয়ার বিষয়ে।

বোস ইনস্টিটিউট এখন ভারত তথা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানকেন্দ্র।

এই বিশাল কাজটি করে গেলেন নিবেদিতা। 

যা খুব কমজন মানুষ এই খবর রাখেন।


বোস ইনস্টিটিউট নিবেদিতা দেখে যেতে পারেননি।

১৯১১ সালের সূচনায় জগদীশ বসু ও লেডি অবলা বসুর আমন্ত্রণে নিবেদিতা বিশ্রামের জন্য দার্জিলিং গেলেন।

সেখানে তিনি কঠিন আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাগ্রহণ করলেন।

ডাক্তার নীলরতন সরকার ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণের চিকিৎসা সত্বেও রোগের কোন উপশম লক্ষিত হল না 

বসু দম্পতি দিনরাত পরিচর্যায় নিযুক্ত রইলেন।

আপ্রান চেষ্টা করেছিলেন জগদীশ বসু, নিবেদিতাকে বাঁচানোর জন্যে।

পারলেন না বাঁচাতে।

মাত্র ৪৪ বছরে নিবেদিতা চলে গেলেন!

নিবেদিতা চলে যাচ্ছেন। 

আর একজন বিজ্ঞানীর চোখে তখন জলে  ভরে উঠছে।

আজ তাঁর জীবনের একটি পরম সম্পদ হারিয়ে গেল!

 এ জীবনে তিনি কোনদিন "ভগিনী ঋণ" শোধ করতে পারবেন না।


তাই বোস ইন্সটিটিউট উদ্বোধন হওয়ার একমাস আগে জগদীশ বসু নিবেদিতার বোন, 

মে উইলসনকে এক চিঠিতে লিখছেন,

" বসু বিজ্ঞান মন্দিরে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে একটি ফোয়ারা ও জলধারা।

আর তার পাশেই থাকবে প্রদীপ হাতে প্রার্থনারত এক নারীর রিলিফ মূর্তি।

এখানেই বেদির নীচে রাখা থাকবে নিবেদিতার চিতাভস্ম।

আর এই  বেদির পাশে রোপন করা হবে একটি শেফালি গাছের চারা।

সেই গাছ থেকে রোজ ফুল

 ঝরে পড়বে বেদীর ওপর।

এই শেফালি গাছটির বীজ নিবেদিতা নিয়ে এসেছিলেন অজন্তা থেকে।"

(তথ্য/নিবেদিতা লোকমাতা/ ডক্টর  শঙ্করীপ্রসাদ বসু, ১ম খন্ড, ২য় পর্ব,পৃ: ৩৮০)


 দার্জিলিং- এ  নিবেদিতার সমাধি মন্দিরে লেখা আছে এই কথাগুলি,

" HERE LIES SISTER NIVEDITA WHO GAVE HER ALL TO INDIA. "


এমন " ভগিনী ঋণ"  কি কখনও শোধ করা যায়?

@ পীযূষ দত্ত। 


তথ্যসূত্রঃ

" ভারত চেতনায় ভগিনী নিবেদিতা।"/ উদ্বোধন কার্যালয়। 

শঙ্করীপ্রসাদ বসু/ "নিবেদিতা লোকমাতা".

ভগিনী নিবেদিতা/ স্বামী তেজসানন্দ/ উদ্বোধন 

স্বামীজির রচনাবলী /

 নিবেদিতার লেখা চিঠি মিস ম্যাকলাউড, সারা বুলকে।

       ( সংগ্রহীত )

     <----আদ্যনাথ রায় চৌধুরী-->

============================

Sunday, August 21, 2022

35>|| ঈশ্বর চাইলে কী না হয় ||..

 


 35>|| ঈশ্বর চাইলে কী না হয় ||..

ভক্ত প্রিয় ভগবান,

 নাকি ভগবান প্রিয় ভক্ত ------

এই কথা টুকু বোঝাতেই এই গল্প কথা।

মনে হয় গল্প কথা,

কিন্তু প্রকৃত সত্য কথা।


        - ভক্ত যেমন ভগবানকে ছাড়া থাকতে পারে না,ভগবানও তেমনি ভক্ত ছাড়া থাকিতে পারে না -"যে যথা মাম প্রপদ্যে,তাংস্তথৈব  ভজামি অহম্"-গীতা।

গোরক্ষপুর গীতাভবনের এক সাধুর কাছে শুনেছিলাম একটি দিব্য ঘটনা -

   " একবার এক ব্রজের সন্তদের দিব্যমন্ডলী ট্রেনে করে প্রয়াগ তীর্থে যাত্রা করে বৃন্দাবনে ফিরছিলেন। তার মধ্যে এক সন্তজী গিরিরাজশীলা গোপাল বিগ্রহ সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

অনেক সন্তদের সাথেই ঠাকুরজীর শীলা বিগ্রহ সবসময়ই থাকে।  

      সন্তজী সেই শীলা বিগ্রহের খুব প্রেম ভক্তিতে সেবা করতেন - নিত্য স্নান করিয়ে পূজা করে কীর্তন করিতেন,ভাগবত পড়িতেন।

আজ রেলে যাত্রা করছেন সেই সন্ত। সকলে মথুরা স্টেশনে নামবেন। যেতে যেতে রেলে সৎসঙ্গে কৃষ্ণ কথা ভাগবত প্রসঙ্গ শুরু হল সকলে তা নিয়ে ভাবুক আলোচনা করছেন।ওই কামরার অনেক যাত্রী ভাগবত কথা শুনছেন। 

       সন্তমন্ডলী মথুরাতে নামবেন।ট্রেন মথুরার কাছে এসে গেছে ।কিন্তু এমন ভাগবত কথা চলছে তাদের খেয়াল নেই কখন মথুরা এসে গেছেন। 

         মথুরা থেকে ট্রেন ছেড়েই যাবে এমন সময় এক যাত্রী সেই সন্তদের বলল "আপনারা নামবেন না? এই তো মথুরা স্টেশন!" 

    সকল সন্তরা তাড়াতাড়ি করে মথুরাতে নামলেন। তাড়াতাড়ি করলেন সাধুরা। এত তাড়া ছিল যে সাধুর কাছে গিরিরাজ শীলা বিগ্রহ ছিল,ট্রেনে উপরের বার্থে কাপড়ের উপর বসানো ছিল,সেটা ভুলে ফেলে রেখেই মথুরা স্টেশনে অন্য সাধুদের সাথে সেই ভাগবত প্রসঙ্গের মধুর কথা বলতে বলতে নেমে গেলেন। এমন ভাগবত আলোচনা হচ্ছিল যা একবারে ঘরে গিয়ে শেষ হল। 

     সাধুজী কুটিয়ায় ফিরে স্নান করে তিলক করে রন্ধন সেরে বিগ্রহ সেবার জন্য আসলেন। দেখলেন শীলা বিগ্রহ নাই। "আমার ঠাকুরজী কোথায় ?" 

   সাধুজী খুঁজতে লাগলেন। কাঁদতে লাগলেন। অন্য সব সাধু আজ সেই সাধুজীর বিগ্রহ ব্যাকুল হয়ে খুঁজেছেন।পাচ্ছেন না। সেই সাধু পাগলের মত প্রাণপ্রিয় গিরিরাজ গোপাল শীলা বিগ্রহ খুঁজছেন সব জায়গায় ।

        তখন কেউ একজন বললেন, "নতুন শীলা বিগ্রহ এনে দেব আপনাকে।" 

সাধুজী বললেন, " এমন হয় নাকি। আমি তো ওনার সাথে বড় হলাম। উনি আমাকে এত দিন সামলালেন। কি করে তাঁকে পরিত্যাগ করি।উনিই আমার প্রাণ।আমার তো ওকেই চাই " -বলে কেঁদে চলেছেন।

     তখন এক সাধুজী এ সাধুকে বললেন, "এমন না তো যে ট্রেনেই আছেন ঠাকুরজী। ওখানে আপনি নিশ্চয়ই ফেলে এসেছেন ঠাকুরজিকে।" 

      সাধুজী বললেন; "হ্যাঁ এটা হতে পারে আমি তাড়াতাড়িতে ফেলে আসলাম আমার প্রানের গিরিরাজ গোপাল বিগ্রহ কে।

কিন্তু এখন তো পাঁচ ছয় ঘন্টা হল। ট্রেন কোথা থেকে কোথায় চলে গেল। আর কি পাব শীলা বিগ্রহকে।" 

          তবুও প্রাণের টানে সেই সাধু দৌড়ে স্টেশন পৌঁছালেন। স্টেশন মাস্টারকে বললেন, "আপনি আমাকে সাহায্য করুন। ট্রেনে আমার এক গুরুত্বপূর্ণ কিছু রয়ে গেছে"   স্টেশন মাস্টার বললেন, "কি হল আমাকে বলুন। কি রয়ে গেছে ট্রেনে?" 

      সাধুজী বললেন, "আমার প্রাণ প্রিয় ঠাকুরজি গিরিরাজ গোপাল রয়ে গেছে গাড়িতে।আমি কিভাবে ফিরে পাবো?"

  স্টেশন মাস্টার বললেন, "ট্রেনের নম্বর বলুন?"

তখন সন্তজী তখন নিজের টিকিট দিলেন।     টিকিট দেখে স্টেশন মাস্টার অবাক,চোখ ছলছল করে উঠলো। সাধুজীকে দণ্ডবত প্রণাম করলেন আর আনন্দে ভক্তিতে  কাঁদতে লাগলেন। সাধুজী কিছু বুঝতে না পেরে বললেন, "কি হল আপনি কাঁদছেন কেন?"

        স্টেশন মাস্টার বিস্ময়ের সাথে বললেন, "সাধুজী এই ট্রেন প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে স্টেশনে দাঁড়িয়ে  আছে।বাঁশি বাজিয়ে ছাড়ার সময় কি জানি কি হল, আর ট্রেন যাচ্ছে না। ড্রাইভার আর কর্মকর্তা সকলে অনেক পরীক্ষা করলেন। কোন অসুবিধা ধরা পড়েনি ট্রেনে। তবুও ট্রেন চলছে না।প্রতিটি ইলেক্ট্রিক তার,ইঞ্জিন সব পরীক্ষা হল। তবুও কোন অসুবিধা খুঁজে পেলেন না। কেন যে ট্রেন যাচ্ছে না বুঝতে পারল না।এখন বুঝছি ভক্তের জন্য ভগবান আজ ট্রেন দাঁড় করিয়ে রেখে এই কাজ করলেন"।

       সাধুজী কাঁদতে লাগলেন আর বললেন,- " বা !! আমার প্রিতম গিরিরাজগোপাল আজ আমার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছে ট্রেন আটকে দিয়ে।"

প্রেম ভক্তিতে আজ সাধুর কান্না যেন আর থামেনা।সেই সাধু ছুটে ট্রেনে উঠিলেন।উপরের সিটে ঠাকুরজিকে তেমনিই বসে থাকতে দেখলেন।যেন তিনি তাঁর প্রিয় ভক্তকে হারিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছেন। আর অপেক্ষা করছেন যেমন করে ভিড় মেলায় ছোট্ট বাচ্চা তার মাকে হারিয়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদে,আজ তেমনি ভগবানও শীলা বিগ্রহ রূপে বসে ভক্তের জন্য অপেক্ষা করছেন।

শীলাবিগ্রহ বুকে জড়িয়ে নিয়ে ট্রেন থেকে সাধুজী নামলেন। ড্রাইভার ট্রেন চালাতে লাগলেন -ট্রেন চলতে লাগল।সত্যিই সকলে অবাক!!! "

     দুনিয়ার মানুষ বলে এই দুনিয়াকে ভালবাসতে।কিন্তু সাধুরা বলেন ভগবানকে ভালবাসতে।কেন বলে সেটা ভক্তগণই বোঝেন!!!


জয় ভক্তপ্রিয় ভগবান।

জয় ভক্ত সাধুসন্তগণ।

জয় জয় শ্রীরাধে।


       " সংগ্রহীত"

   <---আদ্যনাথ রায় চৌধুরী--->

========================

Tuesday, July 19, 2022

34>|| একলব্যে +| কৃষ্ণ +সাত্যকি= युयुधान,||

   34>|| একলব্যে +| কৃষ্ণ +সাত্যকি= युयुधान,||


     || একলব্যে ||

পূর্বানুবৃত্তি: বিচক্ষণ যুধিষ্ঠির ধরতে পারে কেমন করে দ্রোণের প্রশিক্ষণ গোপনে আয়ত্ত করেছে একলব্য। অন্য দিকে কুন্তী এবং তাঁর সন্তানদের সম্পর্কে ভীষ্মসমীপে নানা কদর্য ইঙ্গিত করে চলেন ধৃতরাষ্ট্র ও শকুনি। তীব্র রাগে ভীষ্ম প্রতিবাদ করলে ধৃতরাষ্ট্র জানান, তাঁর অভিযোগ আছে অস্ত্রশিক্ষক দ্রোণের বিরুদ্ধেও। সে সময় দ্রোণ বিভ্রান্ত একলব্যকে নিয়ে। শুধুমাত্র অর্জুনকে প্রদেয় তাঁর যাবতীয় শিক্ষা যদি একান্ত গুপ্তই না থাকে, তা হলে অর্জুনের নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন কেমন করে সম্ভব!

====================

একলব্যের অস্ত্রসম্ভার নির্মাণে বন্য পশুর অস্থি আর শৃঙ্গ ছাড়াও ব্যবহৃত হয়েছে দৃঢ় ও ঘাতসহ নানাবিধ কাষ্ঠ-উপাদান। অরণ্য-সম্পদ থেকেই একলব্য খুঁজে নিয়েছে নানা বেধের শরশলাকা— সূক্ষ্ম থেকে স্থূল, লঘু থেকে গুরু— সমস্ত প্রকার! ওই পর্ণকুটিরের অভ্যন্তরেইতার নানাবিধ নিজস্ব পরীক্ষানিরীক্ষা চলে, গুরুর শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করেও স্ববুদ্ধিতে মৌলিক গবেষণা করতে শিখেছে সে রীতিমতো!

যে বিষয়টি সর্বাধিক চমকিত করল দ্রোণকে তা হল, অস্ত্রের ফলকে লেপন করার জন্য এই নিষাদ সংগ্রহকরেছে নানাবিধ বিষ! অধিকাংশই নিজস্ব উদ্ভাবন। বন্য গাছগাছড়া, বিষাক্ত ফল, কীটপতঙ্গের হুল, ভেকের গরলগ্রন্থি, উন্মাদ-রোগগ্রস্ত পশুর লালারস। আর, সর্পবিষ! অর্থাৎ, রসায়নাগারের রন্ধ্রপথে এ কিশোর বিষবিদ্যার প্রাথমিক বার্তাটিও আত্মস্থ করেছে!

তিরের ফলায় বিষ-রসায়নের প্রয়োগ, অতি গূঢ় জ্ঞান। বস্তুত এই জ্ঞানই হল ধনুর্বেদের চূড়ান্ত স্তর। যত বড় ধনুর্ধারী, তত এই বিদ্যায় তাঁর সিদ্ধি! লোকমুখে প্রসিদ্ধি এমনই যে, এগুলি দুষ্প্রাপ্য সব ‘মন্ত্রসিদ্ধ’ আয়ুধ; দেব-আশীর্বাদ বিনা এদের নাকি পাওয়া অসম্ভব! নানা অতিরঞ্জিত জনশ্রুতি দিয়ে ঘিরে রাখা হয় এদের। 

সর্বোৎকৃষ্ট স্তরের দিব্যাস্ত্র— যথা ব্রহ্মাস্ত্র, ব্রহ্মশির, পাশুপত— এদের ত্রিভুবন-বিধ্বংসী বলে প্রচার করা হয়। আসলে এই সব অস্ত্রের ফলকে এমন বিরল রসায়ন প্রলিপ্ত থাকে যা অমোঘ, দুশ্চিকিৎস্য, নিশ্চিত প্রাণঘাতী। শ্রেষ্ঠতম ও সচ্চরিত্র ক্ষত্রিয়-যোদ্ধা ও সদ্‌ব্রাহ্মণ ব্যতীত এই বিজ্ঞানের অধিকার কাউকে দেওয়া হয় না, প্রয়োগেরও বিধিনিষেধ অনেক। আবার, যিনি এই সব মৃত্যুমুখ আয়ুধের প্রয়োগ শিখবেন, বাধ্যতামূলক ভাবে তাঁকে নিবারণবিদ্যাও জানতে হবে— অর্থাৎ মারণ-বিষের প্রতিষেধক-

বিজ্ঞানও। বহু দিন ধরে বহু প্রাজ্ঞ সাধকের, মূলত রসায়নজ্ঞ ব্রাহ্মণ ঋষিদের গোপন গবেষণায় উঠে আসা, এই বিষ-বিজ্ঞান ও তার প্রয়োগবিদ্যার নির্যাস।

এ বিদ্যা একান্ত ভাবে গুরুমুখী। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় সঞ্চালিত। গুরুই নির্বাচন করেন, কে উপযুক্ত আধার। তাকেই গোপনে দান করেন গুহ্য-সাধনার উত্তরাধিকার। দ্রোণ পেয়েছিলেন পরশুরামের কাছ থেকে। তিনি নির্বাচন করেছেন অর্জুনকে। অর্জুন এখনও গূঢ়তম জ্ঞানের প্রাথমিক স্তরটিতে রয়েছে মাত্র। কিন্তু তাকেই শ্রেষ্ঠ হতে হবে তার প্রজন্মে। সে নির্বাচিত। ধীরে ধীরে সেই পথে চলেছে সে।

সেখানে, এই নিষাদ-নন্দন! প্রতিভায়, সাধনায়, উদ্ভাবনে... অর্জুনের চেয়েও অগ্রবর্তী! নিঃসন্দেহে! সুতপুত্র বসুষেণের মধ্যে অর্জুনের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখেছিলেন দ্রোণ, তার আত্মমর্যাদায় আঘাত করে সুকৌশলে বিতাড়িত করেছেন আশ্রম থেকে! কিন্তু এই অনার্যবালক... একে তো নিষ্ক্রান্ত করার পথই নেই। এ একেবারেই প্রকৃতিদত্ত ব্যতিক্রমী মেধা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে, গুরুর প্রত্যক্ষ সাহায্য ব্যতিরেকেই এত দূর! যদি সত্যই কোনও যোগ্য গুরু একে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাটি নিজ উদ্যোগে দান করেন...

দ্রোণ আরও এক বার শ্বাস নিলেন। তার পর তাঁর গুম্ফ ভেদ করে মৃদু হাসি ফুটে উঠল, “তোমার কৃতিত্বে আমি প্রসন্ন হয়েছি, বৎস একলব্য!” সহাস্যবদনে বললেন আচার্য দ্রোণ, “মৃন্ময় মূর্তি নয়, তুমি প্রত্যক্ষ ভাবেই রক্তমাংসের গুরুর শিষ্য হওয়ার যোগ্য। আমি এই মুহূর্তে তোমাকে শিষ্যত্বে বরণ করলাম।”

এক স্বপ্নাতীত হর্ষের বিভা মুহূর্তে নিষাদবালকের কৃষ্ণবর্ণ মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত করে তুলল, দ্রোণ স্পষ্ট দেখলেন। কিন্তু তার পশ্চাতে দণ্ডায়মান আর একটি শ্যামল আনন যে সেই একই লহমায় মলিনবিবর্ণ হয়ে গেল, তাও দৃষ্টি এড়াল নাতাঁর। অভিমান-বিস্ময়ের যৌথ অভিঘাত যেন কয়েকটি অশ্রুকণা সঞ্চার করে দিয়েছে দু’টি অক্ষিকোণে!

এক বার অর্জুনের সেই ম্লান, হতাশ মুখের দিকে, এক বার ক্রুদ্ধ সাত্যকির দিকে, এক বার হতভম্ব দুর্যোধন আর অশ্বত্থামার দিকে পর্যায়ক্রমে দেখলেন আচার্য দ্রোণ। তার পর যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “অন্তত বিদ্যা-অপহরণের ন্যূনতম পাপটুকুও নবীন শিষ্যের হস্তে লিপ্ত থেকে যাওয়া উচিত নয়, কী বলো জ্যেষ্ঠ কুন্তীনন্দন? কী যেন সামান্য প্রায়শ্চিত্তের কথা বলছিলে তখন?”

“গুরুদক্ষিণা, আচার্য! গুরুকে দক্ষিণা দিয়ে সন্তুষ্ট করলেই...”

একলব্যের দিকে ফিরে আবার হাসলেন ভারদ্বাজ। সুমিষ্ট স্বরে বললেন, “কী? গুরুকে সন্তুষ্ট করার মতো দক্ষিণা প্রদান করতে পারবে তো, বৎস?”

“আদেশ করুন, প্রভু! ফল মধু দুধ মৃগমাংস— যা যা নিয়ে গিয়েছিলাম প্রথম দিন— অর্ধদণ্ডের মধ্যে সব জোগাড় করে আনছি। বা, যদি আরও অন্য কিছু মূল্যবান, দুষ্প্রাপ্য আপনার ইচ্ছা হয়, কিনে আনব বা ধার চেয়ে...” কণ্ঠ কম্পিত হচ্ছিল একলব্যের, অভাবিত আনন্দে, উত্তেজনায়, স্বপ্নপূরণের রোমাঞ্চে, “এই অরণ্যে যা কিছু সংগ্রহ করা সম্ভব, সব... সব...”

“পরিশ্রম করে সংগ্রহ করে আনার মতো দুর্মূল্য দুষ্প্রাপ্য কিছুই নয় সে বস্তু,” দ্রোণ এখনও সহাস্য, “তোমার সঙ্গেই রয়েছে, এখন দক্ষিণা হিসাবে সেটি প্রদানে তুমি সম্মত কিনা, তা-ই দেখার!”

“সঙ্গেই রয়েছে! তা হলে ধরে নিন, আচার্য— সে জিনিস আপনি পেয়েই গিয়েছেন!”

দ্রোণের মুখ থেকে হাস্যলেশ মুছে গেল সহসা। দীর্ঘ দক্ষিণহস্তটি একলব্যের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তবে দাও হে নিষাদ! দিয়েই দাও...”

-------------======-------=======-----

        || কৃষ্ণ ||

কৃষ্ণকে গভীর ভাবে চিন্তিত ও আলোড়িত দেখাল। আসন থেকে উঠে কিছু ক্ষণ পদচারণা করলেন, গবাক্ষপথে চেয়ে রইলেন বাইরের দিকে। গিরিমালার উপরে নক্ষত্রখচিত, গাঢ় অসিতবরণ নৈশ আকাশ, সেখানে শুক্লা তৃতীয়া তিথির ক্ষীণ শশীকলা। সেই ম্লান চন্দ্রমার দিকে তাকিয়ে বৃষ্ণিশিরোমণি বাসুদেব যেন ধ্যানস্থ হয়ে পড়লেন কয়েক পলের জন্য।

কক্ষে একটিমাত্র ঘৃতপ্রদীপ জ্বলছে। শিনিপুত্র কিশোর সাত্যকি এক বার সম্পূর্ণ কক্ষটিতে দৃষ্টি আবর্তিত করে আনল।

কৃষ্ণ যদুবংশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তাঁর ভবনটিও যেমন সাধারণ-দর্শন, নিজস্ব প্রকোষ্ঠটিও অতি নিরাভরণ ও সম্পূর্ণতই বিলাসবর্জিত। অনেকটাই অন্ধকারে ঢাকা। শুধু সাত্যকি আর কৃষ্ণ যেখানে মুখোমুখি কাষ্ঠাসনে বসে আলাপ করছে— সেইটুকু আলোকিত। সচরাচর সন্ধ্যাকালে প্রয়োজনাতিরিক্ত আলোকোদ্ভাস কৃষ্ণ পছন্দ করেন না, একমাত্র অত্যাবশ্যক কর্মের জন্য ছাড়া। সাত্যকি এখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক, কিন্তু এই বিরাট পুরুষের আদর্শ তথা জীবনচর্যা সম্পর্কে সে যথেষ্ট অবহিত। সমগ্র যাদবকুল জানে কৃষ্ণের নীতি। আহারে বিহারে এমনকি প্রহারে সংহারেও দেবকীনন্দন দীর্ঘ কাল সংযম ও অনতিরেক অভ্যাস করে আসছেন। শুধু নিজের জীবনচর্যায় নয়, এই আত্মনিয়ন্ত্রণ তিনি সকলের জন্যই উদাহরণ হিসেবে স্থাপন করতে আগ্রহী।

সাত্যকি সমীহপূর্ণ দৃষ্টিতে বাতায়নলগ্ন কৃষ্ণচ্ছায়ামূর্তিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরুষসিংহ বাসুদেব যে তার মতো নগণ্য নাবালককে স্নেহ করেন, মাঝে মাঝে স্বয়ং তাকে নানাবিধ শিক্ষা দেওয়ার জন্য ডাকেন— এ তার সৌভাগ্য ও গর্ব। দ্রোণের আশ্রমে তার অস্ত্রশিক্ষার ব্যবস্থাও কৃষ্ণের পরামর্শেই আয়োজিত, এ কথা সে জানে।

বয়সে নব্য তরুণ— কিন্তু এই বয়সেই যাদব-প্রধান, বীর কৃষ্ণ। শুধু প্রধান অথবা বীর বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। তিনি একাধারে যদুকুলের বাহু, হৃদয় ও মস্তিষ্ক। সর্বগুণাধার এমন ব্যক্তিত্ব বহু প্রজন্মের মধ্যে এ দেশে অবতীর্ণ হননি। এই যুবা শাস্ত্রজ্ঞানে পণ্ডিত, যুদ্ধবিদ্যায় অপরাজেয়, সৈন্যাপত্যে নিপুণ, কূটনীতিতে সুদক্ষ, রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় অপ্রতিম। যাদবরাজ্যকে বার বার নানা বহিঃশত্রুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে তাঁর ক্ষুরধার কূটবুদ্ধি ও বাহুবলের সমন্বয়। আবার ব্যক্তিগত শত্রুতার বশেও যাঁরা তাঁর ক্ষতিসাধন করতে উদ্যোগী হয়েছে, সেই সব অরাতিদেরও আশ্চর্য প্রকৌশলে তিনি দমন করেছেন। অদ্ভুতকর্মা সদ্য-যুবক এই বার্ষ্ণেয়র নানা অতিমানবিক কীর্তি সম্পর্কে এরই মধ্যে আর্যাবর্তের নানা অঞ্চলে জনপ্রবাদ প্রচলিত হয়েছে— তিনি সাধারণ মানুষ নন, ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী, হয়তো বা স্বয়ং দেব-অবতার! রাজা হতে তিনি উৎসাহী নন, কিন্তু তাঁকেই সসম্ভ্রমে নেতা বলে মেনেছে যাদবদের প্রায় সমস্ত গোষ্ঠী। বৃদ্ধ নৃপতি উগ্রসেনও সিংহাসনে উপবেশন ছাড়া আর তেমন স্বাধিকার প্রয়োগ করেন না— নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব গণপরিষদের উপরেই ন্যস্ত। কৃষ্ণই সেই পরিষদের শেষ কথা। কিন্তু সেই আধিপত্যওতিনি বলপূর্বক প্রতিষ্ঠা করেননি। তাঁর নিপুণ যুক্তিজাল, অব্যর্থ মনস্তত্ত্বজ্ঞান ও শান্ত-মধুর বাচনে তিনি সম্পূর্ণ পরিস্থিতি করতলগত করেছেন।

যাদবকুল বংশানুক্রমে অপব্যয়ী, বিলাসী ও অতিভোগী। ধনের অপচয়েও যেমন— তেমনই যৌনসংসর্গে, মদ্যপানে, কথায়-কথায় অস্ত্রব্যবহারে। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই, নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু নেই তাদের। এমনকি কৃষ্ণভ্রাতা মহাজ্ঞানী মহাবীর বলরাম পর্যন্ত ক্রুদ্ধ হলে হঠকারী ও ধ্বংসোন্মুখ হয়ে ওঠেন, সুরাপাত্র হাতে পেলে জগৎবিস্মৃত হয়ে পড়েন। স্থিতধী কৃষ্ণ আপ্রাণ পরিশ্রম ও উদ্যোগ নিয়ে চলেছেন এই অমিতাচারী উচ্ছৃঙ্খল যদুবংশীয়দের মিতাচার শেখানোর। কিন্তু বিশেষ সফল হয়েছেন কি? যাদবরা তাঁকে সম্মান করে ঠিকই, কিন্তু নেতার অনুসৃত জীবন-নীতিও নতমস্তকে মান্য করবে এত সুশীলতা তাদের রক্তেই নেই কখনও।

সাত্যকি বাসুদেবের মুখ ফেরানোর অপেক্ষা করে রইল। বেশ বোঝা যাচ্ছে, কৃষ্ণ এখনও অনেক কিছু জানতে চাইবেন। এক পক্ষকাল অন্তর আশ্রমিক অবকাশ মেলে, তখন সাত্যকি হস্তিনা থেকে স্বগৃহে আসে, কৃষ্ণ তার কাছ থেকে নানা বিবরণ সংগ্রহ করেন নিভৃতে। প্রচুর প্রশ্ন থাকে তাঁর— দ্রোণের আশ্রম ও শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে, কুরু-রাজকুমারদের গতিবিধি নিয়ে, এমনকি হস্তিনার রাজপুরুষদের কর্মকাণ্ড নিয়েও। তাঁর মূল আগ্রহ অবশ্য তাঁর পিতৃস্বসা-পুত্রদের বিষয়ে। পঞ্চপাণ্ডব-জননী শৌরসেনী কুন্তী যে কৃষ্ণ-পিতা বসুদেবের নিজ ভগ্নী— এ তথ্য সাত্যকি জেনেছে আশ্রমে যাওয়ার পূর্বাহ্ণেই। তাই, অর্জুনের নৈপুণ্য, ভীমের সামর্থ্য বা যুধিষ্ঠিরের সুবুদ্ধি— সব বিবরণ সাত্যকিকে দিতে হয় নিয়মিত। কৃষ্ণ উপদেশ দিয়েছেন, চক্ষু ও কর্ণ সদা সজাগ রেখে চলার— যাতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তথ্যও সযত্নে সংগৃহীত হয়।

কিন্তু, আশ্চর্য! নিজেই সাত্যকিকে বলেছেন বাসুদেব— তাঁর স্বসৃপুত্রদের তিনি এ যাবৎ কখনও চাক্ষুষ করেননি! হিমালয়েই তাদের জন্ম, অনেক কাল সেখানেই তারা যাপন করেছে। কৃষ্ণও নিজের জীবনের উত্তাল ঘটনাবর্তে ব্যতিব্যস্ত থাকার ফলে, তাদের হস্তিনা-প্রত্যাবর্তনের পরবর্তী সময়টুকুতে আর সাক্ষাৎ করতে যেতে পারেননি। কিন্তু এই কুমারদের উত্থান সম্পর্কে তাঁর উৎসাহ-কৌতূহল অপরিসীম। কেন, তা সাত্যকির বোধগম্য হয় না সম্পূর্ণত। শুধু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে সে অনুভব করে, বীর কৌন্তেয়রা কৃষ্ণের কোনও ভবিষ্যৎ-পরিকল্পনার অঙ্গ হতেও পারে হয়তো বা। হয়তো কৃষ্ণের নিজের কাছেও তা এখন অবধি অস্পষ্টতায় আবৃত, তিনি শুধু তথ্যগুলি নিয়ে রাখছেন।

তথ্যাভিজ্ঞতা হল কৃষ্ণের রাজনীতির এক মূল স্তম্ভ, সাত্যকি বেশ উপলব্ধি করে। জম্বুদ্বীপের প্রতিটি রাজ্যে ছড়ানো আছে তাঁর গূঢ়জাল। দক্ষ চরের দল নিত্য বিচরণ করে সর্বত্র। হস্তিনাতেও তারা আছে। কিন্তু নিরাপত্তা-বেষ্টিত আশ্রমের অভ্যন্তরে তারা সম্ভবত মন্ত্রভেদনে অপারগ। তাই কৃষ্ণের এই কূট পদক্ষেপ— একই সঙ্গে সাত্যকির সুশিক্ষা, আর গুপ্ত-সংবাদ আহরণের যৌথ কার্যসিদ্ধি! কী সহজ অথচ কী ব্যতিক্রমী কৌশল! পিতৃগৃহে বয়স্ক যাদবদের আলোচনা শুনেছে সাত্যকি। তাদের ব্যক্তিগত বীরত্ব অতুল হলেও, সংগঠিত সামরিক শক্তি খুব বিপুল নয়। কিন্তু এই যে তথ্য-আহরণের বিস্তারী আয়োজন করে রেখেছেন বাসুদেব— এতে সমগ্র দেশের রাজনৈতিক চালচিত্র সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে বহু পূর্বেই অবহিত হয়ে থাকা যায়। ভাবনার দিক থেকে এগিয়ে থাকা যায় কয়েক যোজন। পূর্বপরিকল্পনা নেওয়া যায় সম্ভাব্য পরিস্থিতিগুলির বিচারে। এ বিষয়টিতে কৃষ্ণের পারঙ্গমতা প্রায় অলৌকিক। সাধারণ ঘটনার মধ্যেই অসাধারণ ব্যঞ্জনা লক্ষ করে নিতে পারেন এই অন্তর্দ্রষ্টা কুশাগ্রবুদ্ধি পুরুষ।

আর, এখন সাত্যকি তাঁকে যে বিবরণ দিচ্ছে— সে তো এক বিরল ব্যতিক্রমী কাহিনি! কৃষ্ণকে তা প্রবল ভাবে আঘাত করবে তা প্রত্যাশিত ছিলই।

বাতায়ন থেকে কৃষ্ণ আবার যখন কক্ষের দিকে মুখ ফেরালেন, তখন তাঁর চক্ষু তীক্ষ্ণ, ললাট ভ্রুকুটি-আক্রান্ত। কিছু ক্ষণ আগে, দ্রোণ-একলব্য সংবাদ শোনার সময়ে যে বিস্ময় ও অবিশ্বাসের রেখাগুলি তাঁর মুখে অঙ্কিত হয়েছিল, তার পরিবর্তে এখন গূঢ় অনুসন্ধানী এক সত্তা জাগ্রত হয়ে ওঠার লক্ষণ পরিস্ফুট।

“তুমি সমস্ত ঘটনা একেবারে সামনে থেকেই দেখেছ তো, যুযুধান?” কৃষ্ণ একটু ঝুঁকে পড়েছেন সাত্যকির মুখের কাছে, “আমি বলছি, চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করে বলছ তো? অপরের মুখে শুনে-আসা বিবরণ, বা জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি— এমন নয় তো?”

“নির্জলা সত্য বৃত্তান্ত, হে বাসুদেব, স্বচক্ষে দেখেছি, দুই ধনু দূরত্বে দাঁড়িয়ে। এখনও সেই করুণ দৃশ্য আমার রোম শিহরিত করছে, এই দেখুন আর্য!”

“দ্রোণ একেবারে সরাসরি বলে দিলেন, ‘দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলিটি দাও?’ নির্দ্বিধায় বললেন?”

“নিষ্কম্প কণ্ঠে! আমি নিজের শ্রবণকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অন্য কুমাররাও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।”

“কিন্তু নিষাদবালক ভীত-বিহ্বল হয়নি, তাই তো বললে তুমি? সে তৎক্ষণাৎ ছুরিকা বার করে...”

“একটি বৃক্ষপত্রের উপর নিজের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ স্থাপন করে সে সেটি কর্তন করে ফেলল! অমানুষিক যন্ত্রণা সে দন্তে দন্ত চেপে ধরে সহ্য করছিল, দেখলাম। অতঃপর, বাম হস্তে সেই পত্রপুট-ধৃত রক্তাক্ত মাংসখণ্ডটি গুরুর দিকে প্রসারিত করে সে বলল, ‘বাম হস্তে গুরুদক্ষিণা দিতে বাধ্য হলাম ভগবন্‌, অপরাধ মার্জনা করবেন...’!”

কৃষ্ণে দ্রুত কয়েকটি শ্বাস ত্যাগ ও গ্রহণ করলেন। যেন ঘ্রাণ নিচ্ছেন, মনে হল সাত্যকির। বাতাসের ঘ্রাণ থেকে যেমন শার্দূল মৃগের গতিপথ চিনে নেয়, তেমনই একাগ্র ও গূঢ়চিন্তিত দেখাচ্ছিল ভ্রূকুটিকুটিল সূক্ষ্মদৃষ্টি বাসুদেবকে।

=========================

        || সাত্যকি= युयुधान,||

মহাভারত বর্ণিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের একজন প্রধান বীর। যদু বংশীয় সত্যকের পুত্র ও শিনির পৌত্র। ওঁর জন্মদত্ত নাম ছিল যুযুধান। সাত্যকি অর্জুনের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন। ভীষ্ম তাকে অধিরথ (শ্রেষ্ঠ শ্রেণীর যোদ্ধা) হিসেবে গণনা করেছিলেন। সাত্যকি ছিলেন কৃষ্ণের অনুগত। পাণ্ডব পক্ষে তিনি যোগ দেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সাত্যকি ভুরিশ্রবার সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধে বিপদগ্রস্থ হন। ভুরিশ্রবা যখন সাত্যকির শিরশ্ছেদ করবার জন্য অসি তুলেছেন, তখন অর্জুন ভুরিশ্রবার বাহু দ্বিখণ্ডিত করেন। এই অন্যায় আচরণের জন্য ভুরিশ্রবা অর্জুনকে ভর্ৎসনা করে যখন যোগযুক্ত হয়ে দেহত্যাগ করছেন, তখন সাত্যকি ভুরিশ্রবার শিরশ্ছেদ করেন। যুদ্ধে শাল্বরাজ সাত্যকির হাতে নিহত হয়েছিলেন। ভুরিশ্রবার পিতা সোমদত্তকেও সাত্যকি বধ করেছিলেন। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের পঁয়ত্রিশ বছর বাদে যখন যদুবংশীয় বীররা পানমত্ত হয়ে পরস্পরের সঙ্গে হানাহানি করছেন, তখন সাত্যকির সঙ্গে কৃতবর্মার বচসা শুরু হয়। নিদ্রিত পাণ্ডব ও পাঞ্চাল বীরদের হত্যাকাণ্ডে কৃতবর্মা অশ্বত্থমার সহকারী ছিলেন বলে সাত্যকি ওঁকে তিরস্কার করেন। কৃতবর্মা সাত্যকির অন্যায় ভাবে ভুরিশ্রবা-বধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। বচসা চরমে উঠলে সাত্যকি অসি দিয়ে কৃতবর্মার শিরশ্ছেদ করেন। তাই দেখে ভোজ ও অন্ধকবংশীয়গণ সাত্যকিকে আক্রমণ করাতে কৃষ্ণ ও রুক্মিনীর পুত্র প্রদ্যুম্ন সাত্যকিকে রক্ষা করার চেষ্টা করলেন। শেষে দুজনেই নিহত হলেন।

=======================


   "যে তীব্র আবেগে তরুণ ধানুকীকে  নির্দ্বিধায় নিজ আঙ্গুলি গুরু-পদে দান করতে রাড়িত করেছিল----সেই আবেগেই এক বিপ্রতীপ রূপ, আজ জ্বলন্ত 

প্রতিবিধিৎসা হয়ে নিরন্তর দগ্ধ করছে তাকে। শ্রদ্ধা-প্রেম-উৎসর্গের চেতনা যখন নিষ্ঠুর প্রতারণার শিকার হয়, তখন সেই চিতাবহ্নি থেকেই জেগে ওঠে প্রেত---

যার নাম ঘৃণা! তার মুষ্টিতে জিঘাংসা--খড়গ, তার স্কন্ধের তুনীরে শপথ-বাণ, তার আকন্ঠ প্রতিশোধ-পিপাসা । সেই তৃষা- নিবৃত্তির জন্য সে করতে পারেনা এমন কর্ম বিশ্বে নেই।"


প্রতিবিধিৎসা==প্রতিবিধানের ইচ্ছা।





Wednesday, July 6, 2022

33>|| সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস= আইনস্টাইন----||

   33>|| সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস----||

আইনস্টাইনের  ড্রাইভার একদিন  আইনস্টাইনকে বললেন

"স্যার - আপনি প্রতিটি সভায় যে ভাষণ দেন সেইগুলো শুনে শুনে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে ।"

-আইনস্টাইন  এ কথা শুনে তো অবাক!

তখন আইনস্টাইন বললেন "বেশ  বেশ তাহলে এর পরের মীটিংয়ে যেখানে যাবো তারা আমাকে চেনেন না, তুমি আমার হয়ে ভাষণ দিও আর আমি ড্রাইভার হয়ে বসে থাকবো ।"

ড্রাইভার এক কথায় রাজি এবং-এর পরের  সভায়  ড্রাইভার হুবহু আইনস্টাইন-এর ভাষণ গড় গড় করে বলে গেলেন । উপস্থিত বিদ্বজ্জনেরা তুমুল করতালি দিলেন । এরপর তাঁরা ড্রাইভারকে আইনস্টাইন ভেবে গাড়িতে পৌঁছে দিতে এলেন ।

-সেই সময়ে একজন অধ্যাপক ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন "স্যার, ঐ আপেক্ষিক এর যে সঙ্গাটা বললেন, আর একবার সংক্ষেপে বুঝিয়ে দেবেন ?"

-আসল আইনস্টাইন দেখলেন বিপদ, এবার তো ড্রাইভার ধরা পড়ে যাবে । কিন্তু তিনি ড্রাইভার-এর উত্তর শুনে তাজ্জব হয়ে গেলেন । 

ড্রাইভার উত্তর দিল। আরে-"এই সহজ জিনিসটা আপনার মাথায় ঢোকেনি ? আমার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করুন সে বুঝিয়ে দেবে ।"

বিঃদ্রঃ- জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে চলাফেরা করলে আপনিও জ্ঞানী হবেন। আপনি যেমন মানুষের সাথে ঘুরবেন তেমনই হবেন। এই জন্যে কথায় আছে, "সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ"

            " সংগৃহীত"।

   <----আদ্যনাথ রায় চৌধুরী---->

==========================

Sunday, June 12, 2022

32>||অস্ত্র-অনুশীলনে শিক্ষা----ধনুর্বেদ

 

 

         32>||অস্ত্র-অনুশীলনে শিক্ষা--------


||  অস্ত্র ও শস্ত্র::+-ধনুর্বেদ’||

শস্ত্র হল সেই সব প্রহরণ যা হাতে ধরে রেখে সম্মুখযুদ্ধ করা হয়, যা নিক্ষেপযোগ্য নয়। নিক্ষেপযোগ্য আয়ুধ, যেমন বিভিন্ন গোত্রের বাণ, ভল্ল, শূল, শক্তি, তোমর, চক্র ইত্যাদিকে সমরবিদ্যা অনুযায়ী বলা হয় অস্ত্র। 

অস্ত্রধারী দূর থেকে আঘাত হানতে সক্ষম, সরাসরি দৈহিক নৈকট্যে আসার প্রয়োজন পড়ে না। তাই খুব বেশি বক্তৃতার অভ্যাসও অনাবশ্যক। 

কিন্তু তরবারি, খড়্গ, ছুরিকা, গদা, কুঠার এই সব শস্ত্র-চালনা হয় প্রতিপক্ষের একেবারে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে। তাই, এ ক্ষেত্রে শারীরিক শক্তি ও সহনক্ষমতাও যেমন অধিক থাকা চাই, তেমন প্রয়োজন অতিরিক্ত মানসিক তেজ। নিজেকে উদ্বুদ্ধ রাখা ও প্রতিপক্ষকে মানসিক চাপে ফেলা— দুয়ের জন্যই শস্ত্রধারীদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ আত্মপ্রশস্তি এবং হুঙ্কার

-প্রতিহুঙ্কারের শিক্ষাও দেওয়া হয়।

তির-নিক্ষেপের বিদ্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ হল পবন-গতি-জ্ঞান। বায়ুর বেগ, অভিমুখ ও উত্থান-নমনের স্পষ্ট ধারণা এবং সেই তিনটি বিষয়কে নিজের শরক্ষেপণের অনুকূলে প্রয়োগ; সেই প্রয়োগ-জ্ঞান অনুযায়ী সেই মুহূর্তের উপযুক্ত নির্মাণ-ভারসাম্যবিশিষ্ট বাণ নির্বাচন করা; কখন লঘু-মস্তক বাণ, কখন গুরু-মস্তক, কখন দীর্ঘ, কখন নাতিহ্রস্ব। বায়ু-গতি-বিজ্ঞান মেনে নির্দিষ্ট-সংখ্যক পক্ষিপুচ্ছ সংযুক্ত থাকে বিভিন্ন তিরের পশ্চাদ্ভাগে, তাতেও আছে প্রযুক্তির গণিত, স্মরণ রাখতে হয় তা-ও। সর্বোপরি সমস্তটাই হতে হবে তাৎক্ষণিক, মৌহূর্তিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে।

একই সঙ্গে শ্যেনদৃষ্টি, উপস্থিত বুদ্ধি, শীতল মস্তিষ্ক, অনুশীলন-অভিজ্ঞতা ও প্রাযুক্তিক জ্ঞান— এই পঞ্চগুণের চূড়ান্ত মাত্রা প্রয়োজন শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হতে গেলে। অন্য কোনও অস্ত্র বা শস্ত্রের বিদ্যা এতগুলি গুণ দাবি করে না, এত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব জানার আবশ্যক হয় না। তাই, একমাত্র এই অস্ত্রবিদ্যাকেই বেদের তুল্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, ‘ধনুর্বেদ’ নামটি সেই মহিমারই দ্যোতক।

 =============================

 অস্ত্র ও  শস্ত্র ::----

অস্ত্র ::----সমরবিদ্যা অনুযায়ী অস্ত্র বলা হয় নিক্ষেপযোগ্য আয়ুধ, যেমন বিভিন্ন গোত্রের বাণ, ভল্ল, শূল,  শক্তি, তোমর, চক্র ইত্যাদিকে।   

অস্ত্রধারী দূর থেকে আঘাত হানতে সক্ষম, সরাসরি দৈহিক নৈকট্যে আসার প্রয়োজন পড়ে না। তাই খুব বেশি বক্তৃতার অভ্যাসও অনাবশ্যক।

শস্ত্র ::----সমরবিদ্যা অনুযায়ী শস্ত্র হল নিক্ষেপযোগ্য নয় এমন  সব প্রহরণ, যেমন  তরবারি, খড়্গ,                          ছুরিকা, গদা, কুঠার   ইত্যাদি।  

         শস্ত্রধারী প্রতিপক্ষের একেবারে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে, যা হাতে ধরে রেখে সম্মুখযুদ্ধ  করা হয়  তাই, এ ক্ষেত্রে শারীরিক শক্তি ও সহনক্ষমতাও যেমন অধিক থাকা চাই, তেমন প্রয়োজন অতিরিক্ত মানসিক তেজ। নিজেকে উদ্বুদ্ধ রাখা ও প্রতিপক্ষকে মানসিক চাপে ফেলা— দুয়ের জন্যই শস্ত্রধারীদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ আত্মপ্রশস্তি এবং হুঙ্কার-প্রতিহুঙ্কারের শিক্ষাও দেওয়া হয়।

 শস্ত্র ::-- শস্ত্র হাতে ধরে রেখে যুদ্ধ করতে হয়।

অস্ত্র::- অস্ত্র নিক্ষেপযোগ্য আয়ুধ।



তির-নিক্ষেপের বিদ্যাকে ‘ধনুর্বেদ’ বলা হয় কেন ??-------

তির-নিক্ষেপের বিদ্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ হল পবন-গতি-জ্ঞান। বায়ুর বেগ, অভিমুখ ও উত্থান-নমনের স্পষ্ট ধারণা এবং সেই তিনটি বিষয়কে নিজের শরক্ষেপণের অনুকূলে প্রয়োগ; সেই প্রয়োগ-জ্ঞান অনুযায়ী সেই মুহূর্তের উপযুক্ত নির্মাণ-ভারসাম্যবিশিষ্ট বাণ নির্বাচন করা; কখন লঘু-মস্তক বাণ, কখন গুরু-মস্তক, কখন দীর্ঘ, কখন নাতিহ্রস্ব। বায়ু-গতি-বিজ্ঞান মেনে নির্দিষ্ট-সংখ্যক পক্ষিপুচ্ছ সংযুক্ত থাকে বিভিন্ন তিরের পশ্চাদ্ভাগে, তাতেও আছে প্রযুক্তির গণিত, স্মরণ রাখতে হয় তা-ও। সর্বোপরি সমস্তটাই হতে হবে তাৎক্ষণিক, মৌহূর্তিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে।

একই সঙ্গে শ্যেনদৃষ্টি, উপস্থিত বুদ্ধি, শীতল মস্তিষ্ক, অনুশীলন-অভিজ্ঞতা ও প্রাযুক্তিক জ্ঞান— এই পঞ্চগুণের চূড়ান্ত মাত্রা প্রয়োজন শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হতে গেলে। অন্য কোনও অস্ত্র বা শস্ত্রের বিদ্যা এতগুলি গুণ দাবি করে না, এত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব জানার আবশ্যক হয় না। তাই, একমাত্র এই ধনুর্বিদ্যাকেই বেদের তুল্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, ‘ধনুর্বেদ’ নামটি সেই মহিমারই দ্যোতক।



দ্রোণ খুব তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তার পরবর্তী ক্রিয়াটুকু দেখলেন। বস্তুত, এই দ্বিতীয় ধাপটি কী ভাবে সম্পন্ন করছে ধানুকী— সেটিই তার নৈপুণ্যের অগ্নিপরীক্ষা। একযোগে একাধিক তির শরাসনে স্থাপন করাই যথেষ্ট দুরূহ। তার পর, একটি শর ক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন অভিমুখে দ্বিতীয় শর! অতি কঠিন কাজ। প্রথমত, পূর্ববর্তী ক্ষেপণটির অভিঘাতে জ্যা তখনও কম্পমান, ফলে শরস্থাপন করাই সমস্যাজনক। দ্বিতীয়ত, অত স্বল্প সময়ে সম্পূর্ণ বিপরীত অভিমুখে বাণ চালানো; বায়ুর ঝোঁক বুঝতেই নাভিশ্বাস উঠবে।

গভীর মনোনিবেশ সহকারে প্রিয় ছাত্রের কার্য দেখলেন দ্রোণ। এবং দেখে অভিভূত হলেন। এই কুমারের দক্ষতা বাস্তবিকই সহজাত। এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি অসম্ভব নমনীয় কিন্তু বলবান। ভীষ্মকে পরামর্শ দিয়ে গুরু দ্রোণ যে এই কুমারের জন্য রাজপুরীতে স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনায় নৃত্য-শিক্ষক এবং যোগব্যায়াম-শিক্ষক নিযুক্ত করেছেন, তার সুফল ফলেছে। সাধারণত কোনও রাজপুত্রকে নৃত্যকলা শেখাতে গেলে পৌরুষ-মদবশত সে তা প্রত্যাখ্যান বা অবহেলা করে, তা-ই স্বাভাবিক। কিন্তু আদর্শ ছাত্র অর্জুন যে কোনও শিক্ষার বিষয়েই শতভাগ আগ্রহী। নৃত্যশিক্ষাতেও পরম সঙ্কোচহীন, অলজ্জ ও উৎকর্ষকামী সে। দ্রোণ লক্ষ করেছেন, নৃত্যাভ্যাসের গুণেই অর্জুনের করতল ও অঙ্গুলির মুদ্রাগুলি অতি নমনীয় ও লঘুসঞ্চালনক্ষম হয়েছে। বিদ্যুদ্বেগে নড়াচড়া করে তার বাহু ও মুষ্টির সমস্ত অস্থিসন্ধি। স্কন্ধ-বক্ষ-গ্রীবা-কটি— সমস্ত পেশি সাধারণ লোকের তুলনায় ত্রিগুণ প্রাণময়— প্রয়োজনে স্তম্ভের মতো সুস্থিত, প্রয়োজনে প্রপাতের মতো সচল। নৈঋেতর তালবৃক্ষটির দিকে সে যে গতিতে ঘুরে দাঁড়াল, যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বায়ুর গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করল এবং মরুৎ-বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে চকিতে নিক্ষেপ করল দ্বিতীয় বাণটি— তা শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ হওয়ার সমস্ত সুলক্ষণে প্রোজ্জ্বল।

একটিই প্রশ্ন করার ছিল দ্রোণের। তিনি কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিন্তু, পার্থ, জম্বুবৃক্ষে তুমি যে উচ্চতায় তির বিদ্ধ করলে, ভূমি থেকে প্রায় তিন হাত ঊর্ধ্বে— তালবৃক্ষে সেই সমতা কিন্তু রক্ষা করতে পারোনি। তালবৃক্ষে তোমার শরটি বড় নীচে বিদ্ধ হল যে, ভূমি থেকে মাত্র এক হাত! এই ত্রুটির কারণ?”

“ত্রুটি নয় তো, আচার্যদেব!” অর্জুন ঈষৎ সহাস্যমুখে কিন্তু অকম্প্র কণ্ঠে উত্তর দিল, “জম্বুবৃক্ষটিকে তো ঋক্ষ কল্পনা করতে বলেছিলেন। তার মর্মস্থল বিদ্ধ করতে তো বাণ মাটি থেকে ওই পরিমাণ উপরেই স্থির করা চাই! কিন্তু তালবৃক্ষ তো বরাহ— তাকে বধ করতে হলে...”

দ্রোণ বিস্ময়ে-আনন্দে বিহ্বল হলেন ক্ষণকাল। এখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক, এখনও শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়— কিন্তু ধনুর্বাণের এই অসামান্য কৃৎকৌশলটি চোখের পলকে সম্পন্ন করার সময়, ওই দুই মুহূর্তের মধ্যেও, এত বিপুল বাস্তববাদী ভাবনার উদ্ভাস ঘটাতে পেরেছে সে তার মস্তিষ্কের কোষে! এমন শিষ্য প্রকৃতই কোটিতে এক মেলে। এ কী অলোকসামান্য প্রতিভা নিয়ে এসেছে পাণ্ডুর তৃতীয় সন্তান!

আচার্যের শুষ্ক চক্ষু আর্দ্র হল। সমস্ত শিক্ষার্থীর সমক্ষেই তিনি আলিঙ্গন করলেন অর্জুনকে, গদগদকণ্ঠে বললেন, “পুত্র! তোমাকে আমি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদে পরিণত করব, এই কথা দিলাম! তোমার জয়ের পথ নিষ্কণ্টক হোক! এখনই তোমার তুল্য প্রতিভাশালী সমগ্র পৃথিবীতে কেউ নেই, এ আমি নিশ্চিত বললাম।”

“কেউ নেই? সত্যিই, গুরুদেব— আমার সমান কেউ নেই?” যেন গুরুর কানে কানে অস্ফুটে বলে আলিঙ্গনাবদ্ধ অর্জুন। পরম স্বীকৃতিটির বিষয়ে নিঃসংশয় হতে চায়।

প্রথম থেকেই দ্রোণ দেখেছেন, প্রশংসা শুনলে এই বালক তীব্র ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়। তার পরবর্তী কাজগুলি আরও কৃতিত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, আরও নিবিড় অনুশীলন-মনোযোগ-পরিশ্রমে নিমজ্জিত করে দেয় নিজেকে। ‘আমি শ্রেষ্ঠ’— এই শব্দগুলি তার কাছে মাদক উত্তেজনার রসায়ন জোগায়।

এই কারণেই, কেবল এই শিক্ষার্থীকে নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্ব দানের জন্যই, নিজ আত্মজ অশ্বত্থামাকেও আজকাল গূঢ় বিদ্যা দেওয়া বন্ধ করেছেন দ্রোণ। অশ্বত্থামা তত বড় আধার নয়, পিতা হয়ে তিনি জানেন। পিতৃ-প্রশ্রয়ে কিছু উৎকৃষ্ট বিদ্যা সে অধিগত করেছে ঠিকই, কিন্তু ওই পর্যন্তই তার সীমা। উত্তুঙ্গতম গ্রহণক্ষমতা বা প্রয়োগ-পারদর্শিতার প্রতিভা নেই কৃপী-নন্দনের। থাক তবে, একটি শাখাতেই ফলবতী হোক সমস্ত শ্রেষ্ঠ মেধাসম্পদ!

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসও সে দিন আশ্রম-দর্শনে এসে এই একই প্রশ্ন করেছিলেন— আচার্যের কোন শিষ্য সর্বাধিক প্রতিশ্রুতি বহন করছে, কে হবে ভবিষ্যৎ ভারতের শ্রেষ্ঠ মহাযোদ্ধা?

দ্রোণ শুনেছেন, ভরতবংশের সমগ্র কাহিনি নিয়ে বেদব্যাস এক মহাকাব্য রচনার উদ্যোগ নিয়েছেন, যা তাঁর শিষ্যদের মুখে-মুখে সারা জম্বুদ্বীপে প্রচারিত হবে। সব দিকে ব্যাসদেবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। চতুর্দিকে তাঁর তথ্য-আহরণের মহতী প্রক্রিয়া চলমান। কুরু-বংশধরদের বিকাশ ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও তিনি সজাগ। বর্তমান কুরুকুমাররা আবার দ্বৈপায়নের প্রত্যক্ষ পৌত্রও বটে, তাই তৃতীয় পাণ্ডবের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে তিনি গ্রন্থে বিশেষ উল্লেখ রাখবেন স্বাভাবিক ভাবেই। দ্রোণ তাঁকে তা নিয়ে নিশ্চিত আশ্বাস দিয়েছেন।

“আমার সমান কেউ নেই, না আচার্য?” এখন জানতে চাইছে ব্যাস-পৌত্র অর্জুন নিজেও।

নিজের মাথাটি দুই দিকে সঞ্চালন করে ‘না বৎস’ বলতে গিয়েও এক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন দ্রোণ, স্তব্ধ ও নিরুত্তর।

আচম্বিতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক কাতর অথচ ক্রুদ্ধ তরুণের মুখচ্ছবি! প্রিয়দর্শন সুগৌর আনন ক্ষোভে আরক্তিম, কণ্ঠে যুগপৎ অসহায়তা ও প্রতিবাদ...

“আপনি অর্জুনের প্রতি এমন প্রকট পক্ষপাতী, আচার্য! ছি! আপনি না গুরু, আপনার না নিরপেক্ষ হওয়ার কথা! তার পরিবর্তে আপনি এমন শঠতা করেন শিষ্যদের সঙ্গে!”

নির্জন মধ্যাহ্নে, সবাই যখন বিশ্রামরত— সে এসে দাঁড়িয়েছিল অভিযোগের উদ্যত অঙ্গুলি নিয়ে। দ্রোণ অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলেছিলেন, “কী বলতে চাও তুমি, রাধেয়! এত বড় অসম্মানের উক্তির স্পর্ধা...”

“নিজ সম্মান তো আপনি স্বয়ং মলিন করে চলেছেন, আচার্য! দিনের পর দিন!” সূত অধিরথের পুত্রটি তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেন ভর্ৎসনাই করছিল গুরুকে, “নিরালা ধাতুশালায় আপনি কেবলমাত্র অর্জুনকে ডেকে নিয়ে আপনার গূঢ়বিদ্যা দান করেন। অন্য সকলকে ছল করে ক্রীড়া-বিলাসে মগ্ন করে রাখেন। কেন, প্রভু, অন্য ধনুর্ধররা কি কৌন্তেয়র সতীর্থ নয়, আপনার শিষ্য নয়? আশ্রমে যা-যা শিক্ষা দেওয়া হবে— ধর্মত ও ন্যায়ত প্রত্যেকেই কি তা পাওয়ার অধিকারী নয়? ...আপনার ছল অনুধাবন করে, আমি কয়েকদিন আপনার আহ্বান ব্যতিরেকেই কর্মশালায় প্রবেশ করেছিলাম— কিন্তু সেখানেও আপনি কপটাচরণ শুরু করলেন। গোপন পাঠ দেওয়ার প্রারম্ভেই আমার হাতে আপনি একটি মৃৎকলস ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “যাও রাধেয়, রাজপথিপার্শ্বের গভীর কূপ থেকে সুপেয় জল নিয়ে এসো!” কখনও বা অসুস্থ গুরুপত্নীর জন্য বৈদ্যগৃহ থেকে ঔষধ আনা, কখনও গাভীর বৎসটিকে গোশালায় বেঁধে রেখে আসা— ইত্যাদি তাবৎ আদেশ পালনের জন্য একমাত্র আমাকেই নির্বাচন করতেন আপনি— এবং ওই মোক্ষম লগ্নটিতেই, আগেও নয়, পরেও নয়! আপনিও বেশ জানেন, আচার্য, আপনি আমার সঙ্গে যা করে চলেছেন তার নাম প্রবঞ্চনা!”

“অর্জুন রাজপুত্র। হস্তিনার কুমার সে। আর আমি... হস্তিনার বেতনভুক শিক্ষক,” দ্রোণ গম্ভীর কিন্তু অনুচ্চস্বরে বলেছিলেন, “অন্নদাতাকে বিশেষ পক্ষপাত দেখানোয় কোনও অধর্ম নেই, অন্নদাতার জন্য প্রাণ অবধি দেওয়া যায়, স্বতন্ত্র বিদ্যাদান তো তুচ্ছ বিষয়! আর শোনো, বসুষেণ! হস্তিনার কুমারের সঙ্গে সূতপুত্রের তুলনা হয় না, জেনো! সমাজে যে-ভেদ প্রচলিত আছে, শাস্ত্রে যে-বর্ণাশ্রম আছে— একটি ক্ষুদ্র শিক্ষাসত্র তার বিপরীত কিছু অনুমোদন করবে, এই প্রত্যাশাই তোমার ভুল। তোমাকে আশ্রমের অন্তর্ভুক্ত করাই আমার অভিপ্রেত ছিল না— তোমার পিতার প্রভাবে তুমি অপ্রাপ্যের স্বাদ পেয়েছ অনেকটাই। এর অধিক পাবে না এখানে। আমি জানি, তুমি অর্জুনকে ঈর্ষা করো। এমনকি, ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান চাও, সেও তার প্রতিস্পর্ধী হওয়ার মানসেই! কিন্তু সে তো তোমার অপ্রাপ্য হে সূতনন্দন— এও তোমার জ্ঞাত থাকা উচিত ছিল!”

হেসেছিল অধিরথ-পুত্র, তিক্ত হাস্য। সক্ষোভে ও সশ্লেষে বলেছিল, “সে আমি অনেক পূর্বেই উপলব্ধি করেছি, গুরুশ্রেষ্ঠ! এও জানি, যে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নষ্ট হয়েছে তাঁর কাছে অধ্যয়ন নিরর্থক। আমি আজই শেষ বারের মতো এই আশ্রম-উদ্যানে পদপাত করলাম। আমি অন্য গুরুর সন্ধানে যাব। জন্ম দৈবাধীন, কিন্তু পুরুষকার আমার আয়ত্ত— আমি নিজ ভাগ্য নিজে নির্মাণে সক্ষম!”

দ্রোণ শুধু বলেছিলেন, “কল্যাণ হোক!”

রাধেয় তাঁকে প্রণাম করেছিল। তার পর বলেছিল, “বিদায়ের আগে একটি প্রশ্নের উত্তর যাচ্ঞা করি হে ভারদ্বাজ!”

“কী?”

“আপনি আমাকেও গভীর ভাবে নিরীক্ষণ করেছেন, আমি জানি। সত্য বলুন, ধনুর্বেদে আমার দক্ষতা কি অর্জুনের চেয়ে কিছু কম বলে আপনার ধারণা? দৃষ্টি বুদ্ধি ধৈর্য মনঃসংযোগ অনুশীলন— এর কোনওটিতেই কি কৌন্তেয় অর্জুন বাস্তবে এই রাধেয়র চেয়ে উৎকৃষ্টতর? যদি আপনি আমাকে তার মতোই স্নেহ ও যত্ন নিয়ে অপক্ষপাতে শিক্ষা দিতেন, যদি ওই ভাবেই নিয়মিত দিতেন গূঢ়তম বিদ্যাগুলি, তবে আমিই কি হতাম না শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর?”

দ্রোণ মৌন ছিলেন কিছু ক্ষণ। তাঁর দৃষ্টি নমিত হয়েছিল আপনা থেকেই, খুব ধীরে ধীরে শুধু বলেছিলেন, “তোমার নতুন আচার্য হয়তো এ বিষয়ে চূড়ান্ত মীমাংসার পথে তোমাকে চালনা করবেন!”

আজ অর্জুনের প্রশ্ন শুনে চকিতে রাধেয়র সেই শাণিত প্রশ্ন মনে পড়ে গেল। পার্থ জানতে চাইছে, ‘আমার সমান কেউ নেই?’ রাধেয়রও জিজ্ঞাসা ছিল, ‘আমার দক্ষতা কি অর্জুনের চেয়ে কিছু কম?’

কুরু-অন্নজীবী দরিদ্র ব্রাহ্মণ দ্রোণ আর অস্ত্রগুরু আচার্য দ্রোণ মুখোমুখি, দু’জনেই নীরব।

মহাগ্রন্থ-লিখনরত বেদব্যাসকেও রাধেয়র বিষয়ে কিছু অবগত করেননি দ্রোণ। কিন্তু ঋষি নাকি সর্বজ্ঞ, অন্তর্দ্রষ্টা... তিনি কি একেবারেই কিছু জানতে পারবেন না?

ক্রমশ

======================