Wednesday, November 24, 2021

31>||মা"সর্বশক্তিময়ী "মা"

 31>||"মা"সর্বশক্তিময়ী "মা"🔱*


শাক্তেরা জগতের সেই  সর্বব্যাপিনী শক্তিকে "মা" ব’লে পূজা ক’রে থাকেন,

কারণ মা-নামের চেয়ে মিষ্ট নাম আর নাই। প্রেমের উচ্চতম বিকাশরূপে পূজা করাকে হিন্দুরা ‘দক্ষিণাচার’ বা ‘দক্ষিণমার্গ’ বলেন, ঐ উপাসনায় আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়, মুক্তি হয়—এর দ্বারা কখনও ঐহিক উন্নতি হয় না।  আর "মা"এর ভীষণ রূপের, রুদ্রমূর্তির উপাসনাকে ‘বামাচার’ বা  ‘বামমার্গ’ বলে; সাধারণতঃ এতে সাংসারিক উন্নতি খুব হ’য়ে থাকে, কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতি বড় একটা হয় না। কালে ঐ থেকে অবনতি এসে থাকে, আর যারা ঐ সাধন করে, সেই জাতির একেবারে ধ্বংস হ’য়ে যায়। জননীই শক্তির প্রথম বিকাশ-স্বরূপ, আর "জনকের" ধারণা থেকে "জননীর" ধারণা ভারতে উচ্চতর বিবেচিত হ’য়ে থাকে। "মা"-নাম করলেই শক্তির ভাব সর্বশক্তিমত্তা, ঐশ্বরিক শক্তির ভাব এসে থাকে, শিশু যেমন নিজের মাকে সর্বশক্তিময়ী মনে ক’রে ভাবে—"মা" সব করতে পারে। সেই জগজ্জননী ভগবতীই আমাদের অভ্যন্তরে নিদ্রিতা কুণ্ডলিনী—তাঁকে উপাসনা না ক’রে আমরা কখনই নিজেদের জানতে পারি না। সর্বশক্তিমত্তা, সর্বব্যাপিতা ও অনন্ত দয়া সেই জগজ্জননী ভগবতীর গুণ।  জগতে যত শক্তি আছে, তিনিই তার সমষ্টিরূপিণী। জগতে যত শক্তির বিকাশ দেখা দেয়, সবই সেই "মা"। তিনিই প্রাণরূপিণী, তিনিই বুদ্ধিরূপিণী, তিনিই প্রেমরূপিণী। তিনি সমগ্র জগতের ভিতর রয়েছেন, আবার জগৎ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক্‌। তিনি একজন ব্যক্তি, তাঁকে জানা যেতে পারে এবং দেখা যেতে পারে  (যেমন ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁকে জেনেছিলেন ও দেখেছিলেন)। 

সেই জগন্মাতার ভাবে প্রতিষ্ঠিত হ’য়ে আমরা যা খুশি তাই করতে পারি। তিনি অতি সত্ত্বর আমাদের প্রার্থনার উত্তর দিয়ে থাকেন। তিনি যখন ইচ্ছা যে কোনরূপে আমাদের দেখা দিতে পারেন। সেই জগজ্জননীর নাম ও রূপ দুই-ই থাকতে পারে, অথবা রূপ না থেকে শুধু নাম থাকতে পারে। তাঁকে এই-সকল বিভিন্ন ভাবে উপাসনা করতে করতে আমরা এমন এক অবস্থায় উপনীত হই, যেখানে নাম রূপ কিছুই নেই, কেবল শুদ্ধসত্তামাত্র বিরাজিত। যেমন কোন শরীরবিশেষের সমুদয় কোষগুলি (cells) মিলে একটি মানুষ হয়, সেইরূপ  প্রত্যেক জীবাত্মা যেন এক একটি কোষস্বরূপ, এবং তাদের সমষ্টি ঈশ্বর আর সেই অনন্ত পূর্ণ তত্ত্ব (ব্রহ্ম) তারও অতীত। সমুদ্র যখন স্থির থাকে তখন তাকে বলা যায় ‘ব্রহ্ম’, আর সেই সমুদ্রে যখন তরঙ্গ ওঠে তখন তাকেই আমরা ‘শক্তি’ বা 'মা’ বলি। সেই শক্তি বা মহামায়াই দেশকাল নিমিত্ত স্বরূপ। সেই ব্রহ্মই মা। তাঁর দুই রূপ একটি সবিশেষ বা সগুণ, এবং অপরটি নির্বিশেষ বা নির্গুণ। প্রথমোক্ত রূপে তিনি ঈশ্বর, জীব ও জগৎ; দ্বিতীয় রূপে তিনি অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। সেই নিবুপাধিক সত্তা থেকেই ঈশ্বর, জীব ও জগৎ এই ত্রিত্বভাব এসেছে।

 ============

*তথ্যসূত্রঃ  স্বামী বিবেকানন্দের ‘দেববাণী’ থেকে গৃহীত*

           ( সংগৃহীত)

        <---আদ্যনাথ--->

==========================

30>|| যেদিন মা সূক্ষ্ম দেহ লাভ করলেন ।।

 30> ||যেদিন মা সূক্ষ্ম দেহ লাভ করলেন  ||


শরীর যাবার আগের দিন সকাল থেকেই মায়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আমার আবার তার আগের দিন পেট খুব খারাপ হওয়াতে শরীর এত দুর্বল যে নড়বার শক্তি নেই। মহারাজ (শরৎ) আমাকে তাঁর ঘরে বসেই মাছের ঝোলভাত খেয়ে নিতে বললেন। 

এদিকে মার  শ্বাসকষ্ট এত বাড়ছে যে তাঁর সে কষ্ট যেন চোখে দেখা যায় না। একতলা থেকে তিনতলা - সারাবাড়ি সেই শব্দ শোনা যাচ্ছে। চোখদুটি যেন বেরিয়ে আসছে। মা তো কোনও বাছবিচার করেন নি। যত পাপীতাপীকে বুকে নিয়েছেন বলে তাঁর এই কষ্ট! সাধুভক্তে বাড়ী ভরে গেল। 

সারারাত্রি আমি আর সুধীরাদি মায়ের পায়ের কাছটিতে বসেছিলুম। যোগীনমা আমাকে একঘটি জলে মায়ের পায়ের কাছটিতে আঙুল ডুবিয়ে চরণামৃত করে নিতে বললেন। শ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখে ফোঁটা ফোঁটা গঙ্গাজল দিতে লাগলুম। ধীরে ধীরে শব্দ কমে আসতে লাগল, ক্রমে সব শান্ত। তখন রাত একটা বেজে গেছে। সেদিন চৌঠা শ্রাবণ (১৩২৭)।

যে মায়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না, এখন সেই মায়ের রূপ আর ধরছে না - একেবারে দুর্গাপ্রতিমার মতো!

মাকে সরু লালপেড়ে গরদের কাপড় পরিয়ে দেওয়া হলো। পরদিন বেলা এগারটায় মায়ের খাট মাথায় করে কাশীপুর হয়ে বরানগর কুঠিঘাট অবধি নিয়ে আসা হলো। আমাকে গোলাপ-মা, যোগীন-মা সঙ্গে যেতে বারণ করেছিলেন। সুধীরাদি জোর করে আমার হাত ধরে বের করে নিয়ে এলেন। তখন খুব ভগবানের নাম, হরি-সঙ্কীর্তন হচ্ছে। ওদের সঙ্গে সঙ্গে কুঠিঘাট পর্যন্ত গেলুম। সেখান থেকে মহারাজেরা ও ভক্তেরা মাকে নিয়ে একটা বড় নৌকায় উঠলেন। আমরা মেয়েরা পাশে পাশে একটা ছোট নৌকায়।

বেলা দুটোয় বেলুড়ের ঘাটে পৌঁছে মাকে আমতলায় নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর সেখানে পূজা ও ভোগ নিবেদন। পরে গঙ্গার ঘাটে মাকে স্নান করানো হবে। কাপড় দিয়ে আড়াল করা হলো। আমি আর সুধীরা-দি মায়ের শরীর তুলে নিয়ে গঙ্গার জলে রেখে তাঁকে স্নান করালুম। ইদানীং অসহ্য গায়ের জ্বালায় মা প্রায়ই বলতেন, "গঙ্গায় নিয়ে চল, গঙ্গায় নিয়ে চল।" তখন মায়ের শরীর যে কী হালকা ও নরম লাগছিল।

ঐ কাপড়খানা বদল করে তাঁকে আর একটা নতুন সরু লালপেড়ে গরদ পরানো হলো। এবার সাধুরা তাঁকে আবার আমতলায় নিয়ে গেলেন। সেখানে দ্বিতীয়বার মাকে আরতি করা হয়। আমি সব দেখলুম, মনে কিছুই হলো না। তারপর যেখানে বর্তমানে মায়ের মন্দির সেখানে চিতা সাজানো হলো। আমি আর সে দৃশ্য দেখতে পারছি না, কী দেখব? সুধীরা-দির পিছনটিতে শুয়ে পড়লুম। 

চন্দনকাঠের চিতায় মাকে শুইয়ে দিয়ে শরৎ মহারাজ ও অন্যসব মহারাজরা বেলপাতা, ধুনো ও গুগগুল প্রদক্ষিণ করে করে আহুতি দিতে লাগলেন।

প্রবোধ-দি জোর করে আমার হাত ধরে টেনে তুলে বললেন, "একবার দেখ না কী সুন্দর দেখাচ্ছে!" দেখলুম আগুনের শিখা আকাশ ছুঁয়ে কত উঁচুতে উঠেছে। তখন তো এখনকার মতো ট্রাম-বাসের সুবিধা ছিল না, তাই খুব বেশী ভিড় হয়নি। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ওপারে তখন বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু এপারে বৃষ্টি নেই।

মায়ের শরীরের কিছুই চোখে পড়ল না, কি জানি কি দেখব ভেবে এতক্ষণ চোখ তুলে তাকাইনি। এখন আমরাও প্রদক্ষিণ করে তিনবার আহুতি দিলুম। 

ফিরে...দু-তিন দিন আর উদ্বোধনে যাইনি, মন সরছিল না। ফাঁকা বাড়ি, কী দেখতে যাব? যোগীন-মা ডেকে পাঠালেন। মায়ের ঘর তখনো খালি পড়ে ছিল। সেদিকে আর তাকানো গেল না, কেবলই চোখ ফেটে জল আসছে। যোগীন-মা কাঁদছেন আর বলছেন, "তোরাও যদি না আসবি, আমরা কি করে থাকব? মা চলে গেলেন, সব শূন্য লাগছে।"

[প্রব্রাজিকা ভারতীপ্রাণা বিরচিত শ্রীশ্রীমায়ের চরণপ্রান্তে থেকে নিবেদিত]

            (সংগ্রহীত)

          <--আদ্যনাথ-->

==========================


Tuesday, November 9, 2021

29>|| ভূত চতুর্দশী' ও কিছু কথা :-

 29>||-: 'ভূত চতুর্দশী' ও কিছু কথা :- 

কার্ত্তিকমাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি 'ভূত চতুর্দশী' নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে কালীপুজো ও ভ্রাতৃদ্বিতীয়া এসবের পাশাপাশি ধনতেরস্ (ত্রয়োদশী তিথি), ছট্ পূজা, ভূত চতুর্দশীও পালনীয় দিন হিসেবে গণ্য হয়েছে।

    দীপাবলির যে পাঁচদিন মুখ্যতঃ উৎসব পালিত হয়, তার প্রথম দিনটি ধনতেরস্, দ্বিতীয় দিন ভূত চতুর্দশী এবং এরপরের দিনই দীপাবলির মুখ্য উৎসবটি হয়ে থাকে। কথিত আছে, বিজয়া দশমীর দিন শ্রীরাম লঙ্কাবিজয় করার পর কার্ত্তিকমাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে অযোধ্যায় ফিরে এসেছিলেন। তাই মহানন্দবশতঃ অযোধ্যাবাসী তাদের প্রিয় রাজকুমারের ফিরে আসার আনন্দে এই দিনটিতে সারা অযোধ্যাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করেছিলেন। সেই থেকেই এই দিনে 'দীপাবলি-উৎসব' শুরু। এই দিন পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র কালীপূজা হয়। কিন্তু, দীপাবলির সাথে কালীপূজার সম্পর্ক নেই। যেহেতু সেইদিনই অমাবস্যা থাকে, তাই অমাবস্যায় কালীপূজা হয়। 

যাই হোক, ফিরে আসা যাক মূল প্রসঙ্গে।

              হিন্দুধর্মের প্রতিটি উৎসবেরই অনেক গূঢ়তর মাহাত্ম্য থাকে, 'ভূত চতুর্দশী'- এই দিনটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এই দিনের মাহাত্ম্যও অনেক বেশি। "মূলতঃ অশুভ শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে মনোবলকে দৃঢ় রেখে লড়াইপূর্বক  শুভশক্তির জাগরণ তথা বিজয় ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা"- এটি ভূত চতুর্দশীর মূল গূঢ়-মাহাত্ম্য। 

     'ভূত চতুর্দশী' নামের দ্বারাই বোঝা যায়, ভূত,প্রেত, আত্মা, কালো জাদুবিদ্যা ইত্যাদির সাথে দিনটি ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। ভূত চতুর্দশীর রাতেই প্রত্যেক পরিবারের ১৪ টি মৃত পূর্বপুরুষের আত্মাগণ তাদের  নিজেদের  জীবিত উত্তরপুরুষ-বংশধরদের সাথে দেখা করতে আসেন। এছাড়াও বিভিন্ন আত্মারা তাদের প্রিয় ব্যক্তিদেরও দেখতে আসেন, এটাও মান্যতা।

            আসলে 'ভূত' বলতে 'যা অতীত'-এই অর্থও বোঝানো হয়। তাই আমাদের অতীত পুরুষগণ অর্থাৎ আমাদের গত পূর্বপুরুষকেও সেদিন আমরা স্মরণ করি এবং তাদের উদ্দেশ্যে সারা বাড়িতে ১৪ টি মাটির প্রদীপ   জ্বালিয়ে ঈশ্বর ও আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে থাকি। ভূত চতুর্দশীর রাতটিতে আসুরিক তথা ঋণাত্মক শক্তিসমূহ অধিক শক্তিশালী হয়। তাই আসুরিক শক্তি তথা ঋণাত্মক আত্মাদের দূরে রাখতেও সারা বাড়ি প্রদীপের আলোয় আলোকিত করা হয়। এছাড়া 'চতুর্দশী তিথি'-টি হল কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশতম দিন, তাই এই 'চতুর্দশপ্রদীপ প্রজ্বলন' তার তাৎপর্য্যও বহন করে। তেল বা ঘি দ্বারা মাটির প্রদীপ জ্বালালে তা মানব শরীরের পক্ষে উপকারী এবং তার দ্বারা গৃহে প্রবাহিত বায়ু পরিশোধিত হয়ে জীবানুমুক্ত হয়- এর বৈজ্ঞানিক সত্যতাও রয়েছে।

'রূপচতুর্দশী' নামেও এই দিনটিকে জানা যায়। এই নামটি মৃত্যুর দেবতা যমরাজের সাথে সম্পর্কিত। এই দিন সন্ধ্যায় যমরাজের জন্যও বহু বাড়িতে বাড়ির দক্ষিণদিকে একটি প্রদীপ জ্বালানো হয়ে থাকে। বলা হয়, এই দিন যমরাজের উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলে নরকের ভয় বা অকালমৃত্যুর ভয় কাটে।

পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার পাশাপাশি ভূত চতুর্দশীতে ভেষজগুণযুক্ত ১৪ টি শাকমিশ্রিত ব্যঞ্জন খাওয়া হয়ে থাকে, যা বিশেষ পুষ্টিযুক্ত। আসলে এটি শীতের প্রারম্ভে আমাদের শরীরের জন্য বিশেষ রোগ-প্রতিরোধকের কাজ করে থাকে। অনেকের মতে, ভূত চতুর্দশীর আগের দিন অর্থাৎ 'ধনতেরস্' (ত্রয়োদশী তিথি) হলো 'ধন্বন্তরী' নামক আয়ুর্বেদজ্ঞ-এর জন্মতিথি, যিনি কাশীর রাজা ছিলেন। তাঁর জন্মতিথি ত্রয়োদশী তিথির একেবারে শেষ লগ্নে, চতুর্দশীর শুরুতেই। তাই তাঁকে সন্মান জানিয়েই ও আয়ুর্বেদকে স্মরণ করেই ১৪ টি শাকমিশ্রিত ব্যঞ্জন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খাওয়া হয়ে থাকে, শীতকালের প্রারম্ভের পরিবর্তিত আবহাওয়া থেকে  সুস্থ থাকবার জন্যই। তাই এই ত্রয়োদশী দিনটিকে তাঁর নামানুসারেই 'ধন্বন্তরী তেরস্' বা 'ধন্তেরস্' বলা হয়। এছাড়াও এই দিনের সাথে ধন ক্রয় বা লাভেরও একটি সম্পর্ক আছে। যদিও অনেকের বিশ্বাস, এই দিনে সোনা-রূপা ইত্যাদি ক্রয় বা লাভ করলে অথবা মহালক্ষ্মী পুজো বা কুবেরের পুজো করলে গৃহস্থের ধন-ঐশ্বর্য্য ও শ্রী বৃদ্ধি হয়। তাই এই ত্রয়োদশী দিনটিকে হিন্দিতে 'ধনতেরস্' নামেও অভিহিত করা হয়। তাই দেশের বিবিধ প্রান্তের (বিশেষতঃ উত্তরভারত ) বহু মানুষ এই দিনে সোনা, রূপা ইত্যাদি ধনসম্পদ ক্রয় করে থাকেন এবং বিবিধ পূজাপাঠও করে থাকেন। 

 পুরাণ মতে, ভূত-চতুর্দশীর দিনই শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করেন। তাই এই দিনটি 'নরক চতুর্দশী' নামেও খ্যাত। নরকাসুর ষোলো হাজার একশোজন কন্যাকে বন্দিনী করে রেখেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ মাকালীর সহায়তায় নরকাসুরকে বধ করে তাদের মুক্ত করেন। এই কন্যাদের পিতা-স্বামীরা তাদের আর নিজের করে মেনে না নিলে, তারা লোকলজ্জায় আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন শ্রীকৃষ্ণ সকলকে পত্নীরূপে বরণ করে তাদের যোগ্য সন্মান দিয়েছিলেন। 

  আবার, মা চামুণ্ডা এই দিনেই প্রবল হওয়া আসুরিক শক্তি ও ঋণাত্মক প্রেত-আত্মাদের দূরীভূত করে থাকেন মহাকালীরূপে। এছাড়া, বছরের অন্যান্য কৃষ্ণচতুর্দশীর থেকে এই চতুর্দশী বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। তাই একে 'কালীচতুর্দশী' -ও বলা হয়। এই নামটি মাকালীর মহত্ব বা কালোতম দিন- এই দুই অর্থেই হয়ে থাকতে পারে বলেই মনে হচ্ছে।

  তাছাড়া, দিবালীর আগের দিনই যেহেতু অনেকে এই দিনেও প্রদীপ জ্বালায়, বাজি পোড়ায়, তাই দেশের কোনো কোনো জায়গায় (মূলতঃ উত্তরভারতে) একে 'ছোটী দিবালী'-ও বলে।

  গ্রামের দিকে এই দিনটিতে খুবই সাবধানে সকলে বাড়ির ভিতরেই বসবাস করেন, মনে একটি মৃদু ভয় রেখে। কারন মান্যতা আছে, এইদিন সমস্ত ঋণাত্মক শক্তি জাগরিত হয়। তান্ত্রিক সিদ্ধিও এই দিনেই অধিক ফলপ্রসূ হয়ে থাকে, এই দিন তাই দেবী কালীর পুজো করে তাতে নরবলির প্রথা এক সময় ছিল, তান্ত্রিক সিদ্ধিকে সফল করবার জন্য। প্রত্যন্ত গ্রামে বহু পূর্বে শিশুদের এই সিদ্ধিলাভের আশায় বলিপ্রদান করা হতো। নরবলির মধ্যে শিশুবলি উৎকৃষ্ট - এই অন্ধবিশ্বাস ছিল। তাই প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে শিশুদের এই দিন বাড়িতেই রাখা হতো, বেরোতে দেওয়া হতো না। যাই হোক, এই ক্রূরতম অন্ধবিশ্বাস আপাতত প্রশাসন বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে, আগামীতেও এটি বন্ধ থাকুক এই বিষয়ে তারা তৎপর। প্রশাসনের চাপে এখন নরবলি বন্ধ হওয়ায় তা ছাগবলির মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। এর দ্বারা মনস্কামনা পূরণ হয় এটি সিদ্ধতান্ত্রিকদের মত। কালোজাদুবিদ্যাও এই দিনেই অধিক প্রয়োগ করা হয়ে থাকে বলেও মত । 

  বহু শ্মশানে ও গৃহস্থে এইদিন কালীপুজোও হয়ে থাকে। মাকালীকে সুগন্ধজাতীয় দ্রব্য (যেমন- চন্দন,পুষ্প ইত্যাদি) দিয়ে পূজা দিলে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হওয়া যায়। সকল প্রকার বিঘ্নসমূহকেই বিনাশ বা দূরীভূত করে শুভ শক্তির প্রকাশের আশায় মাতৃশক্তির আরাধনা করা হয়। এই দিন দেবীর পূজার মাধ্যমে মনের আলস্য, ঈর্ষা, দ্বেষ, মোহ ইত্যাদি সকল প্রকার ঋণাত্মক ভাব ত্যাগ করে মনে ভক্তিভাব আনার চেষ্টা করা হয়ে থাকে।


🌺🙏🌺🙏🌺🙏🌺🙏🌺

28>|| কালী বা কালিকা= বর্ননা ||

          28>|| কালী বা কালিকা= বর্ননা||


কালী বা কালিকা তাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায় কালীপূজা করে থাকে। তন্ত্র অনুসারে, কালী দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত।

কালী দুর্গার ললাট থেকে উৎপন্না হয়েছেন—এই বাক্যের তাৎপর্য যে, ললাটের সংকোচনেই ক্রোধভাব প্রকাশিত হয় বলে সদা ক্রোধান্বিতা; রণরঙ্গিনী করাল-বদনা কালীকে ললাট-সম্ভবা বলা হয়েছে। বাস্তবিক কালীও দুর্গার রূপান্তর বিশেষ। ক্রোধাবস্থাপন্না শক্তিকেই কালী বলা হয়েছে।

চণ্ডবধ কালে অসুরগণ সহ যুদ্ধ করতে করতে ক্রোধভরে ভগবতীর মুখ কৃষ্ণবর্ণ হয়ে উঠার পর তাঁহার ললাটদেশ হতে করালবদন অসি-পাশ প্রভৃতি অস্ত্রপাণি কালিকাদেবীর আবির্ভাব হয়েছিল। (মার্কণ্ডেয় পুঃ ৮৭/৫)

কালিকাপুরাণে এর রূপাদি এভাবে বর্ণন আছে –

“নীলোৎপলের ন্যায় শ্যামবর্ণ, চারহাত, দক্ষিণহাত দুইটিতে খট্বাঙ্গ ও চন্দ্রহাস, বামহাত দুইটিতে চৰ্ম্ম ও পাশ, গলায় মুণ্ডমালা, পরনে বাঘের চামড়া, কৃশাঙ্গ, দাঁত দীর্ঘ, অতিভয়ঙ্কর লোলজিহবা, আরক্তচক্ষু, ভীমনাদ, কবন্ধ বাহন, বিস্তৃত মুখ ও কর্ণ স্থুল। এই দেবী তারা ও চামুণ্ডা নামেও অভিহিত হয়ে থাকেন। এর আটজন যোগিনী তাদের নাম-ত্রিপুরা, ভীষণা, চণ্ডী, কত্রী, হন্ত্রী, বিধাতৃকা, করালা ও শূলিনী। এই সকল যোগিনীগণও দেবীর সাথে পূজিত এবং অনুধ্যাত হয়ে থাকেন। দেবীগণের মধ্যে এরই পূজা করলে সৰ্ব্বকামনা সিদ্ধ হয়।” (কালিকা ৬০ অঃ)

তিনি দশ মহাবিদ্যার মধ্যে প্রথম মহাবিদ্যা। যথা তন্ত্রসারে,—

“কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।

ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধুমাবতী তথা ॥

বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।

এতা দশ মহাবিদ্যা সিদ্ধবিদ্যাঃ প্রকীৰ্ত্তিতাঃ ॥


কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধুমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা এই দশমূর্ত্তির নাম দশ মহাবিদ্যা; তাঁদের সিদ্ধবিদ্যা ও বলা হয়ে থাকে। সতী দক্ষযজ্ঞে যাবার সময় শিবের নিকট বারবার অনুমতি চাইলেন, কিন্তু মহাদেৰ কোনক্রমেই তাঁকে অনুমতি না দেওয়ায় সতী এই রূপে দশমূর্ত্তি ধারণ করে শিবকে ভীত করেছিলেন এবং তাঁর অনুমতি পেয়েছিলেন।

যত কন সতী শিব না দেন আদেশ।

ক্রোধে সতী হৈলা কালী ভয়ঙ্করবেশ ॥ (অন্নদা মঙ্গল ২৯)

কালীমূর্ত্তির ধ্যান মন্ত্র যথা-----

ওঁ করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম্।

কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুন্ডমালাবিভূষি তাম্ ॥

সদ্যশ্চিন্নশিরঃ খড়গবামাধোর্দ্ধক রাম্বুজাম্।

অভয়ং বরদঞ্চৈব দক্ষিণোদ্ধার্ধপাণিকাম্ ॥

মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব দিগম্বরীম্।

কন্ঠাবসক্তমুন্ডালী-গলদ্রুধিরচর্চিতাম্ ॥

কর্নাবতংসতানীতশ বযুগ্মভয়ানকাম্।

ঘোরদ্রংষ্টাং করালস্যাং পীণোন্নতপয়োধরাং ॥

শবনাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মখীম্।

সৃক্কদ্বয়গলদ্রক্ত-ধারাবিস্ফুরিতাননাম্ ॥

ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শ্মশ্মানালয় বাসিনীম্।

বালার্কমণ্ডলাকা রলোচনত্রিয়ান্মি তাম্ ॥

দস্তুরাং দক্ষিণব্যপিমুক্ তালম্বিকচোচ্চয়া ম্।

শবরূপমহাদেবহৃদয় োপরি সংস্থিতাম্ ॥

শিবাভির্ঘোররাবা ভিশ্চতুর্দিক্ষু সমন্বিতাম্।

মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম ॥

সুখপ্রসন্নবদনাং স্মেরানন সরোরুহাম্।

এবং সঞ্চিন্তেয়ৎ কালীং সর্বকাম- সমৃদ্ধিদাম্ ॥ (তন্ত্রসার)


দেবী দক্ষিণা কালী করালবদনা ভয়ঙ্করী, মুক্তকেশী ও চতুর্ভুজা, তিনি দিব্য জ্যোতি সম্পূর্ণা, মুন্ডমালা ধারিণী। মায়ের বামদিকের নিচের হাতে সদ্যচ্ছিন্নিত মুণ্ড, উপরের বাম হাতে খড়গ। ডানদিকের উপরের হাত অভয় মুদ্রায় এবং নিচের হাত বরমুদ্রা ধারণ করে  আছেন। মায়ের  গায়ের রং কালো মেঘের প্রভার মত  শ্যামা। তিনি দিগম্বরী অর্থাৎ বস্ত্রহীনা।  উনার গলার মুন্ডমালা গুলো থেকে বের হওয়া রক্ত উনার দেহ কে  রঞ্জিত করছে,  দুটি শবশিশু তার কর্ণভূষণ হওয়াতে দেবীকে ভয়ঙ্করী দেখাচ্ছে। তিনি তাঁর দাঁত দিয়ে নিজের জিহ্বাকে কামড় দিয়ে আছেন, তিনি কোমরে বেঁধে রেখেছেন হাতের মালা। তাঁর মুখে  মৃদুহাসি এবং উনার মুখ থেকে রক্তের ধারা বের হচ্ছে আর উনার মুখে অনন্ত কোটি সূর্যের তেজ বিদ্যমান। তিনি অতিশয় ক্রোদ্ধা, ভয়ংকর নাদকারিণী, উনার তিনটি চোখ আর সেই সকালের সূর্যের মত লালপ্রভাময়। উনার চারদিকে  চিৎকার করছে  শিয়ালের দল। আমি সেই দেবীর ধ্যান করি যিনি শবরুপ মহাদেবের হৃদয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। যার মুখ সুখ-প্রসন্নতায় ভরা। যিনি মোক্ষদায়িনী  এবং সকল ইচ্ছাপূরণকারিণী।

দেবীর অঙ্গের তাৎপর্যঃ


দেবীর মাথায় অর্দ্ধচন্দ্র তাঁহার মোক্ষ-প্রদান শক্তির পরিচায়ক।তাহা হইতে নিঃসৃত অমৃত সাধক কে  অমৃতত্ব বাঁ মোক্ষ প্রদান করিয়া থাকে। দেবী  মুক্তকেশী। তাঁর মুক্তকেশ চির-বৈরাগ্যের প্রতীক। জ্ঞান-অসির আঘাতে তিনি অক্টপাশ ছেদনকারী মা চির বৈরাগ্যময়ী। তাই তাঁর কালো চুল বিস্তৃত।

দেবীর তিন চোখ তিনটি আলোর প্রতীক, চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি। অন্ধকার বিধ্বংসী তিন শক্তির প্রকাশ। অজ্ঞতা, চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার থেকে মুক্ত করে। তিনটি চোখে দেবী অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে প্রত্যক্ষ করেন। কারণ,এই শক্তিই হল সৃষ্টি স্থিতি ও প্রলয়ের কর্তা।  দেবীর কানে দুতি বালকের শব যার অর্থ নির্ব্বিকার, নিস্কাম,শিশু্ভাবাপন্ন সাধক মায়ের অতি প্রিয়। দেবী রক্তবর্ণের জিহ্বাকে সাদা দাঁত দিয়ে কামড়ে রেখেছেন। লাল রং  রজোগুণের প্রতীক, সাদা রং সত্ত্বগুণের প্রতীক। সাদা দাঁত দিয়ে লাল জিহবাকে চেপে রাখা। অর্থাৎ সত্ত্বগুণর দ্বারা রজোগুণকে দমন করে রাখা। রজোগুণ ভোগের গুন, ঈশ্বর বিমুখ করে। রজোগুণ দমনের জন্য এই প্রতীক। অনেক সময় আমরা কোন অন্যায় বা মিথ্যাচার করলে জিহ্বার কামড় দেই অর্থাৎ অন্যায় করার স্বীকৃতি।

দেবীর গলায় পঞ্চাশটি মুন্ড দিয়ে মালা পরানো। পঞ্চাশটি মুন্ড পঞ্চাশটি অক্ষরের প্রতীক। ১৪ টি স্বরবর্ণ এবং ৩৬ টি ব্যঞ্জনবর্ণ, অক্ষর ব্রহ্ম, যার ক্ষয় নেই, শব্দ ব্রহ্ম, অক্ষরের দ্বারাই শব্দের উৎপত্তি হয়। এর অবস্থান মস্তকে। আমরা  মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা দেব বা দেবীর বন্দনা করি। এই মন্ত্রের অবস্থান মাথার  তালুতে সহস্রার পদ্মের মধ্যে। তাই অক্ষরের প্রতীক মুন্ড তাঁর গলায় হাত কর্মের প্রতীক। আমাদের সকল কর্মের ফলদাতা  তিনি। সকাম ভক্ত যারা তারা অতৃপ্ত কামনা নিয়ে দেহত্যাগ করে বলে পুনরায় মাতৃ জঠরস্থ হয়, হস্ত মেখলা প্রতীকে সকাম ভক্তের পুণর্জন্ম লাভ করার তত্ত্ব নিহিত।

দেবীর চাইতে বড়তো কিছুই নেই। তাই তিনি কি পরিধান করবেন? বিশ্বব্যাপী শক্তির অবস্থান। শক্তিকে আবরিত করা যায়না। তিনি স্বয়ং প্রকাশ। তাই দেবী উলঙ্গ।দেবী কখন দক্ষিণ পদ কখন বাম্পদ, অগ্রে স্থাপন করেন ইহার অর্থ এক পদে অতীতকে অন্যপদে ভবিষ্যত কে অধিকার করিয়া আছেন।

কালো রং সকল বর্ণের অনুপস্থিত। তাই কালো। কখনো বা তিনি শ্যমা- শ্যামবর্ণা। কালো রং ভয়ের উদ্রেক করলেও শ্যাম রং কোমলতা জাগায়। স্নিগ্ধতা ও কমনীয়তা জাগায়। তাই মাতৃসাধক কালী শ্যামবর্ণা রূপেও দর্শন করেছেন।

মা কালী শবরূপী শিবের বুকে দন্ডায়মানা। শিব স্থির, কালী গতিময়ী। গতি ঠিক রাখতে হলে স্থিরের উপর তার প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। শিব শুভ্রবর্ণ, কালী কালো বর্ণ। সাধক কূটস্থ দর্শন কালে এই শুভ্র রং বেষ্ঠিত কালো রং সাধনায় দেখে থাকেন।

কালীর রূপকল্পনাঃ-

মহাকালী, দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, গুহ্যকালী ও রক্ষাকালী প্রভৃতি নাম অনুসারে কালীমূৰ্ত্তির বিবিধ ভেদ আছে। ইনিই মূল প্রকৃতি; স্বল্পবুদ্ধি ও দুৰ্ব্বল মানুষের উপাসনা কার্য্যে সুবিধা করবার জন্যই তন্ত্রা আদিশাস্ত্রে এই প্রকৃতির কালী, তারা প্রভৃতি নাম ও রূপ কল্পিত হয়েছে। মহানিৰ্ব্বাণতন্ত্রেও এভাবে লেখা আছে-

“উপাসকানাং কার্য্যায় পুরৈব কথিতং প্রিয়ে।

গুণক্রিয়ানুসারেণ রূপং দেব্যাঃ প্রকল্পিতম্ ॥


(মহানিৰ্ব্বাণ ১৩ উল্লাস।)


উপাসকদের কার্য্যের সুবিধার জন্যই গুণক্রিয়া অনুসারে দেবীর রূপ কল্পিত হয়েছে।


আদ্যশক্তির প্রধান মূৰ্ত্তি কালী। শাক্ত উপাসকের মধ্যে প্রায় দশআনা লোক এই মূৰ্ত্তির উপাসক। ভগবতীর যতগুলি মূৰ্ত্তি আছে, তারমধ্যে দুর্গা ও কালীমূৰ্ত্তির বছল প্রচার। এই মূর্ত্তির কল্পনা কতকাল পূর্ব্ব হতে চলে আসছে, তা সহজে নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিত ও সেই মতাবলম্বী প্রাচ্য পণ্ডিতরা বলেন, এই মূৰ্ত্তি হিন্দুদের মৌলিক মূৰ্ত্তি নয়, ভারতের আদিম অধিবাসী অনাৰ্য্যদের দেবদেবী হতে সংগৃহীত হয়েছে। এরূপ মীমাংসা বা কল্পনায় কোন ফল আছে কি না তাহা বুঝা যায় না; কারণ, অনেক অনেক প্রাচীন পুরাণে ভগবতীর এই মূৰ্ত্তির কথা পাওয়া যায়। তবে এই পৰ্য্যন্ত স্বীকার করতে হবে যে, তান্ত্রিক যুগেই এই মূৰ্ত্তির উপাসনার নানাবিধ বিধি-নিয়ম সঙ্কলিত ও বহুল প্রচার হয়েছে।


তন্ত্রের কথা ছেড়ে আগে দেখা যাক, পুরাণ আদিতে ভগবতীর কালীমূর্ত্তির উৎপত্তি, পূজা, ধ্যান ইত্যাদি সম্বন্ধে কি কি বিবরণ পাওয়া যায়।


পুরাণের মধ্যে মার্কণ্ডেয় পুরাণখানি অপেক্ষাকৃত প্রাচীন বলে গণ্য। দেবীমাহাত্ম্য চণ্ডী-যা পাঠ বা শ্রবণ করলে ইন্দ্রের ঐশ্বৰ্য্যতুল্য ঐশ্বৰ্য্য ভোগ হয়—সেই চণ্ডীই এই পুরাণের অন্তর্গত। কালিকামূৰ্ত্তির উৎপত্তির কথা চণ্ডীতে দুই স্থানে কথিত হয়েছে। প্রখম,-মহিষাসুর বধের পর যখন দেবতারা শুম্ভ নিশুম্ভের অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়ে দেবীর স্তব করেছিলেন, সে সময়ে ভগবতী জাহ্নবীজলে স্নান করতে যাওয়ার ছলে, তাঁদের নিকট গিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, তোমরা এখানে কেন ? দেবতারা এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই ভগবতীর শরীর থেকে শিবা অম্বিকা নির্গত হয়ে বললেন,-দৈত্যপত্তি শুম্ভকর্ত্তৃক নিরাকৃত ও তার ভাই নিশুম্ভ কর্তৃক পরাজিত এই দেবতারা একত্র হয়ে আমার স্তব করছে। অম্বিকা ভগবিতীর শরীর-কোষ হতে উৎপন্ন হয়েছেন বলে তিনি কৌষিকী নামে বিখ্যাত হলেন ও হিমাচল আশ্রয় করে রয়েছেন। কৌষিকীর উৎপত্তির পর ভগবতীও নিজ গৌরবর্ণ ত্যাগ করে কৃষ্ণবর্ণ হয়েছিলেন বলে তিনি ‘কালিকা’ নামে বিখ্যাত হলেন এবং তিনিও হিমাচল আশ্রয় করে অবস্থান করতে লাগলেন; এই কালিকার রূপ কি, তা এস্থানে চণ্ডীতে উল্লেখ নেই। তারপরে চণ্ডীতে দ্বিতীয়স্থানে যে কালীমূর্ত্তির কথা আছে, তা এই;- কৌষিকীর হুঙ্কারে শুম্ভের সেনাপতি ধূম্রলোচন ভস্মীভূত হলে, শুম্ভ চগুমুগু নামক দুই প্রচণ্ড সেনাপতিকে বহুসৈন্য সহ কৌষিকীকে আনবার জন্য আদেশ দিলেন। চণ্ডমুণ্ড সৈন্যবল-পরিবৃত হয়ে মহাদৰ্পে দেবীর নিকট হিমাচলে উপস্থিত হলেন। দেবী তাদের দর্প দেখে সামন্য হাসলেন মাত্র। চণ্ডমুণ্ড এসে দেবীকে ধরতে অগ্রসর হল। দৈত্যদ্বয় নিকটে আসামাত্র দেবী মহাক্রোধে তাদের প্রতি তাকালেন। ক্রোধে তাহার মুখমণ্ডল কৃষ্ণবর্ণ হয়ে উঠল এবং তাঁহার ভ্রুকুটি-কুটিল ললাট হতে অতি শীঘ্ৰ এক দেবী নির্গত হয়ে, অসুরদেরকে প্রহার করতে লাগলেন। এই দেবীই কালী। এর রূপ এভাবে চণ্ডীতে উল্লেখ আছে-


“কালী করাল-বদনা বিনিষ্ক্রান্তাসিপাশিনী।

বিচিত্রখট্বাঙ্গধরা নরমালাবিভূষণা ॥

দ্বীপিচর্মপরীধানা শুষ্কমাংসাতিভৈরবা।

অতিবিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণা।

নিমগ্নারক্তনয়না নাদাপূরিতদিঙ্মুখা ॥

কালী, করালবদনা (লম্বিত-মুণ্ড-হস্তা), অসিপাশধারিণী, বিচিত্র থট্বাঙ্গধরা, নরমুণ্ডমালা শোভিতা, ব্যাঘ্ৰ চৰ্ম্ম পরিধানা, শুষ্কমাংসা, অতি ভয়ানক মূৰ্ত্তি, অতি বিস্তৃতমুখমণ্ডল, লোলরসনা, ভীষণা, গাঢ়-রক্তনয়না, হুঙ্কার শব্দে দিগ্মণ্ডল পরিপূর্ণকারিণী। এই কালী যুদ্ধে চণ্ডমুণ্ডকে বিনাশ করে, কৌষিকীর নিকট তাঁদের মুণ্ড দুইটি উপহার দিয়ে বললেন,- আমি চণ্ডমুণ্ড নামক মহাপশু দুটিকে হনন করে এনেছি, এখন যুদ্ধযজ্ঞে শুম্ভ নিশুম্ভকে তুমি নিজে সংহার কর। কৌষিকী হেসে কালীকে বললেন,-চণ্ডমুণ্ডকে বধ করেছ, তারজন্য তোমার নাম চামুণ্ডা বলে বিখ্যাত হবে।

সচরাচর যে কালী বা শ্যামা-মূৰ্ত্তি দেখা যায় তার সাথে এই মূৰ্ত্তির সম্পূর্ণ ঐক্য নেই, কিছুটা সাদৃশ্য আছে।

রক্তবীজবধের সময়ে এই কালী জিহ্বা বিস্তার করে রক্তবীজের শরীর থেকে নির্গত সমস্ত রক্ত ধারণ করে পান করেছিলেন। কৌষিকীর অস্ত্রপ্রহারে রক্তবীজ বিনষ্ট হয়।

চণ্ডীতেও কালীপূজার কোন বিধান নেই। শুম্ভ নিশুম্ভবধের পর দেবী দেবতাদের কে যে পূজাপদ্ধতি বলেছেন; তা শারদীয় মহাপূজার কথা।

দেবীভাগবতের ৫ম স্বন্ধে ২৩শ অধ্যায়ে কৌষিকী উৎপত্তির পর পাৰ্ব্বতীর শরীর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে কালিকা নামে প্রসিদ্ধ হওয়ার কথা আছে; কিন্তু এই কালিকার নাম কালরাত্রি বলেই কথিত হয়। চণ্ডীতে বলা এই কালিকার কোন কার্য্য পাওয়া যায় না, কিন্তু দেবীভাগবতে এর সাথে ধূম্রলোচনের ঘোর সংগ্রাম ঘটেছিল এমন বর্ণন হইয়াছে ও যুদ্ধের পরে এরই হুঙ্কারে ধূম্রলোচন বিনষ্ট হয়। ইনি বরাবর কৌষিকীর পাশে উপস্থিত ছিলেন। দেবীভাগবতেও চণ্ডমুণ্ড বধের সময় কৌষিকীর কপাল হতে ব্যাঘ্ৰচৰ্ম্মাম্বরা, ক্ররা, গজচৰ্ম্মোত্তরীয়া, মুণ্ডমালাধরা, ঘোরা, শুস্কবাপীসমোদরা, খড়গপাশধরা, অতি ভীষণা, খট্ট্বাঙ্গধারিণী, বিস্তীর্ণ-বদন, লোলজিহ্বা কালীর উৎপত্তি কথা আছে। এই কালী চামুণ্ডা নামে বিখ্যাত হন। ইনিই রক্তবীজের রুধিরপায়িনী। এছাড়া অন্যান্য পুরাণেও কালী, ভদ্রকালী, মহাকালী ইত্যাদি নাম পাওয়া যায়, কিন্তু উৎপত্তি সম্বন্ধে বিশেষ কোন বিবরণ পাওয়া যায় না।

কালীমূর্ত্তীর রূপক ভেদ করলে বুঝা যায়, ইহা সৰ্ব্ববিধ্বংসী মহাকালের প্রণয়িনী-অনন্তকালরূপী শিব পদতলে দলিত হয়েছেন, সৰ্ব্বধ্বংসকারিণী শক্তিজ্ঞাপক অসি হন্তে; ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালবাচক ত্রিনয়ন ইত্যাদি।

এস্থানে যতগুলি কালীমূৰ্ত্তির কথা দেওয়া হল, তার কোনটাই শিবারূঢ়া নহে, শবাসনার কথা ‘শ্যামা’ শব্দে দ্রষ্টব্য।


শক্তি পূজায় যে পঞ্চমকার যথা- মদ্য-মাংস-মৎস্য-মুদ্রা-মৈথুন এর কথা পাই তার অর্থ লোকনাথ বসু তাঁর হিন্দুধর্ম মর্ম গ্রন্থে লিখেছেন, পঞ্চ ম কারের প্রথমটি অর্থাৎ মদ কেবল এক পানীয় নয়। তা আসলে ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে ক্ষরিত অমৃতধারা বা সাক্ষাৎ আনন্দ। তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে খুলে যায় মস্তিষ্কের উপরিতল বা ব্রহ্মরন্ধ্র। তখন যে আনন্দধারা প্রবহমান হয়, তাই আসলে মদ্য বা কারণ! আবার সাধকজীবন ও দশমহাবিদ্যা গ্রন্থে তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীর মত, ‘মা মা’ বলতে বলতে যখন ভক্তি নেশার মতো থিতু হবে অন্তরে, তখন সেই মাদকতাকেই বলতে হবে মদ্য!


কালিকা উপনিষদও মদ্য বা কারণবারির এই অন্তর্নিহিত অর্থের দিকেই জোর দিয়েছে। তার নবম শ্লোকে বলা হয়েছে, পঞ্চমকারের বেদসম্মত আধ্যাত্মিক অর্থ বুঝে যিনি দেবীরর পূজা করবেন, তিনিই সতত ভজনশীল, তিনিই ভক্ত। তাঁর প্রচ্ছন্নতা দূর হয়ে মহত্ব প্রকাশিত হয়। তিনি নিরবিচ্ছিন্ন সুখ শান্তি লাভ করে সংসারপাশ থেকে চিরমুক্ত হন। সিদ্ধমন্ত্রজপকারী সাধকের অনিমাদি অষ্টসিদ্ধি লাভ হয়। তিনি জীবন্মুক্ত, সর্বশাস্ত্রবিদ হন। তাঁর হিংসাবৃত্তি বিনষ্ট হওয়ায় তিনি সকল জীবের বিশ্বাসভাজন হন।


কিন্তু, সাধারণ মানুষ মদ্যের এই গূঢ় অর্থ ভুলেছে। বঙ্গে তন্ত্রমতে কালী উপাসনা জনপ্রিয় হওয়ায় একসময় পঞ্চ ম কার-কে কেবল বহিরঙ্গেই ব্যবহার করতে থাকে সুবিধাবাদী শাসকশ্রেণি। সে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের সময়ের কথা। তখন মদ মানে উল্লাস, মাংসে-মৎস্যে ভোজন, মুদ্রা মানে যৌনসুখের আসন এবং মৈথুন বলপূর্বক শরীরসম্ভোগ! শান্ত বাঙালি চৈতন্যদেবের প্রভাবে এবং ইংরেজ শাসনের নৈতিকতার জেরে যৌনাচারের দিকটি পরে এড়িয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু জিভে লেগে রইল মাংস আর মৎস্যের স্বাদ। আর, মাথায় রইল মদের আচ্ছন্নতা। প্রতি বছর কালীপুজোর রাতে যা তুঙ্গে ওঠে। ঠিক বাল্মীকি প্রতিভার ডাকাতরা যা বলেছে- “আজ রাতে ধুম হবে ভারি, নিয়ে আয় কারণ বারি, জ্বেলে দে মশালগুলো, মনের মতন পুজো দেব- নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে!”


কিন্তু, মা কি ভক্তের এই বিস্মৃতিতে আদৌ প্রসন্ন হন?


তথ্যসূত্র- বিশ্বকোষ চতুর্থ খন্ড, দেবদেবীতত্ত্ব সহ পুরাণ ও উপনিষদ।