Wednesday, January 17, 2024

51> || পৌষ সংক্রান্তির পিঠে পুলি ||

 51> || পৌষ সংক্রান্তির পিঠে পুলি ||


সেদিনের সেই আমাদের ছেলেবেলার পৌষ সংক্রান্তির মেলা আর ঘরে মা জেঠিমার হাতে বানানো পিঠে পুলি।

মকরসংক্রান্তির পিঠে পুলি বাড়ির

সবাই খাবে । সেদিনের সেই মজা পিঠে খাবার আনন্দ , আহা সেকি ভুলবার!


ওনারা যখন বসবেন পিঠে পুলি  গড়তে , কত্ত আয়োজন তার, নতুন চালের গুড়ো চাউল ঢেকিতে পিষে আবার কখনো যাতে পিষে নিতেন ,  তার পরে নারকেল , গরুর দুধ , খেজুর গুড় , তিল , চিনি , খোয়া , ক্ষীর , ঘি , মধু , বিউলির ডাল বাটা , মুগসিদ্ধ , কাঁচালঙ্কা , চুই ঝাল ,ভাজা মশলা। 


ছোটবেলায় নারকেলের নাড়ুর লোভে আমরা  মায়ের পাশে পাশেই ঘুর ঘুর করতাম, ছোট ভাই মায়ের আঁচল ধরে বসে থাকতো রান্নাঘরে । 

পিঠে তৈরি করবার কতো ব্যবস্থা 

 বেগুনের বো়ঁটায় তেল লাগিয়ে চাটুতে সেই তেল লাগানো বোটা ঘষে  তেল বুলিয়ে  পাটিসাপটা বানানো হতো

এ ছাড়া আরও কত রকমের পিঠে হতো,


দুধপুলি , মুগপুলি , রাঙাআলুর পুলি , রসবড়া , ফুলঝুড়ি , কাওনর ধানের খৈ এর মোয়া , 

 দুধরাজ পিঠা , গোলাপ পিঠা , চাঁদপাকন , ঝিনুকপিঠা , সরলাপিঠা , কালাইপুড়ি , বিবিয়ানা বা জামাইভুলানো পিঠা , ভাপা পিঠা , গোকুল পিঠা , ঝালপিঠা , ছাঁচ পিঠা , ছিটকা পিঠা , চাপড়ি পিঠা , পাটিসাপটা , 

চুইপিঠা , মালপোয়া , ঝালপোয়া , জামদানী পিঠা , আন্দশা , হাঁড়িপেটা , দৈল্যা , চুষির পায়েস আরো কত্ত কি ! পিঠের  সুগন্ধে ঘর ভরে যেত । 

মনে পড়ে সেদিনের সেই ছড়া---


" আওলা চাল, বকের পাক

যেমন পিঠা তেমন থাক "


 "সারা রাজ্যে সাজো সাজো রব । পয়লা পৌষ থেকেই মেয়েরা ঘরে ঘরে করছে তুঁষতুষলি ব্রত । রোজ ভোরে স্নান সেরে কাচা কাপড় পরে গাইছে ,"


" তোষলা গো রাই ,

তোমার দৌলতে আমরা ছ'বুড়ি পিঠে খাই।"


পৌষ মাসে কিছু পূজাও হতো,

যেমন 

বৌ ও মেয়েরা দল বেঁধে পৌষলক্ষ্মী অরুণার পুজো করতেন।

ঘর ঝেড়ে পুছে , তোরঙের সব গরমকাপড় রোদে দিয়ে ভালো করে রোদ লাগিয়ে গুছিয়ে রাখতো । 

তারপরে হতো বসুমতী পুজো । তুলসীমঞ্চে আলপনা দিয়ে ফল মিষ্টি আর বাস্তুসাপের জন্য দুধ রেখে ধূপ দীপ জ্বালিয়ে পুজো হতো। এরপর ক্ষেত্রপাল , নগরপালের ধ্যান করে বারবার তিনবার বলতে হয়--


"ঔ বাস্তুদেবায় নমঃ ।" 


বাস্তুপুজো সেরে হবে শস্যোৎসব , আউনি-বাউনি পুজো । নতুন ধানের শীষের ছড়া দিয়ে শিষের বিনুনি করে বানাতে হয় আউনি আর বাউনি । তাকে সাজানো হয় মুলোর ফুল , সর্ষে ফুল , আমপাতা , তেল , হলুদ , সিঁদুর দিয়ে । নতুনধান তুলে ধানের গোলায় , ঢেঁকিশালে , বাক্স প্যাঁটরা তোরঙ্গে গুঁজে দিতে হয় আউনি আর বাউনিকে ।আর আমাদের  হাতে হাতে ঘুরত তিলকূট , চিনির মঠ , বুড়ির চুল ( হাওয়াই মেঠাই সে এক  রোমান্টিক ব্যাপার) ।

বাচ্চারা হাতে হাতে, কদমা , ছোলা , মঠ খেয়ে সমস্ত দিন দৌড়া দৌড় খেলা মাঠে

ধুলো উড়িয়ে আনন্দে মাতোয়ারা । 


ওদিকে  ঢেঁকিতে চিড়ে কুটতে কুটতে গান গাইতেন---


"এসো পৌষ যেওনা,

ভাতের হাঁড়িতে থাকো পৌষ যেও না ,

পৌষমাস লক্ষ্মীমাস যেওনা .... "

তার পরে মনে পড়ে পৌষের কেঁদুলীর বাউল মেলা। কেঁদুলীতে জয়দেবের মেলায় দলে দলে হাটুরে মানুষ চলেছে , আউল বাউল ফকির নিকিন্নি সবাই ।

সে এক অতিসুন্দর ও অদ্ভুত মেলা।

কতো যে বাউল আছেন সেটা বোঝা যায় এই কেঁদুলীর মেলায়।

ওদিকে চলছে ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া , দুপুরে উড়বে ঘুড়ি । দক্ষিনয়নান্ত । উত্তরায়ণের সূচনায় ঘুড়ি উড়িয়ে সুয্যিদেবকে পেন্নাম জানাবে সবাই । 

আজ শেষবারের মতন হবে মূলোর ছেঁচকি  , কারণ মাঘমাসে মূলো খেতে নেই , ,(খনার বচন) ।



" পিঠে গড়তে গড়তে বড়রানীর চোখ থেকে জল পড়ে । রাজপুত্তুর কোন দূরদেশে গেছে পড়াশোনা করতে । সঙ্গী রাজামশাই । শূন্য ঘর , খাট , বিছানা । রানী খায় না , কিছু খেতে গেলেই মনে হয় , আহা , ছেলেটা বড় ভালোবাসতো ! বিদেশ বিঁভুইতে আউলা ঝাউলা খাইয়া বাপ ব্যাটায় দিন কাটায় । আশেপাশের সব বাড়িতে পিঠার ধুম । বড়রানী চোখমুছে প্রথম পিঠা বিলাইকে দেয় , মনে করে ছেলেকে দিল । পরেরটাও দেয় , ভাবে রাজামশাই খেল । সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে শাঁখ বাজে , প্রদীপ জ্বলে , সবার বাড়িতে হ‌ইহ‌ই ।"


"পৌষমাসে পিঠেপুলি , মহা ধুমধাম

ঘরে ঘরে পিঠে গড়ে , ধন্য পল্লীগ্রাম

দুধপুলি, গুড় পিঠে , নারিকেল আর 

সকলে করিছে পিঠে সকলপ্রকার ।" 

( লক্ষ্মণ ভান্ডারী )


"সব ঘরে আলো জ্বলে , পিঠে হয় , মহাধুমধাম । বড়রানী পিঠে গড়ে , একখান তার পোলার নাম , একখান বরের নাম ।"


ঋণ : বাংলার ব্রতকথা , অবনঠাকুর।

    <---আদ্যনাথ রায় চৌধুরী--->

==========================

No comments:

Post a Comment