51> || পৌষ সংক্রান্তির পিঠে পুলি ||
সেদিনের সেই আমাদের ছেলেবেলার পৌষ সংক্রান্তির মেলা আর ঘরে মা জেঠিমার হাতে বানানো পিঠে পুলি।
মকরসংক্রান্তির পিঠে পুলি বাড়ির
সবাই খাবে । সেদিনের সেই মজা পিঠে খাবার আনন্দ , আহা সেকি ভুলবার!
ওনারা যখন বসবেন পিঠে পুলি গড়তে , কত্ত আয়োজন তার, নতুন চালের গুড়ো চাউল ঢেকিতে পিষে আবার কখনো যাতে পিষে নিতেন , তার পরে নারকেল , গরুর দুধ , খেজুর গুড় , তিল , চিনি , খোয়া , ক্ষীর , ঘি , মধু , বিউলির ডাল বাটা , মুগসিদ্ধ , কাঁচালঙ্কা , চুই ঝাল ,ভাজা মশলা।
ছোটবেলায় নারকেলের নাড়ুর লোভে আমরা মায়ের পাশে পাশেই ঘুর ঘুর করতাম, ছোট ভাই মায়ের আঁচল ধরে বসে থাকতো রান্নাঘরে ।
পিঠে তৈরি করবার কতো ব্যবস্থা
বেগুনের বো়ঁটায় তেল লাগিয়ে চাটুতে সেই তেল লাগানো বোটা ঘষে তেল বুলিয়ে পাটিসাপটা বানানো হতো
এ ছাড়া আরও কত রকমের পিঠে হতো,
দুধপুলি , মুগপুলি , রাঙাআলুর পুলি , রসবড়া , ফুলঝুড়ি , কাওনর ধানের খৈ এর মোয়া ,
দুধরাজ পিঠা , গোলাপ পিঠা , চাঁদপাকন , ঝিনুকপিঠা , সরলাপিঠা , কালাইপুড়ি , বিবিয়ানা বা জামাইভুলানো পিঠা , ভাপা পিঠা , গোকুল পিঠা , ঝালপিঠা , ছাঁচ পিঠা , ছিটকা পিঠা , চাপড়ি পিঠা , পাটিসাপটা ,
চুইপিঠা , মালপোয়া , ঝালপোয়া , জামদানী পিঠা , আন্দশা , হাঁড়িপেটা , দৈল্যা , চুষির পায়েস আরো কত্ত কি ! পিঠের সুগন্ধে ঘর ভরে যেত ।
মনে পড়ে সেদিনের সেই ছড়া---
" আওলা চাল, বকের পাক
যেমন পিঠা তেমন থাক "
"সারা রাজ্যে সাজো সাজো রব । পয়লা পৌষ থেকেই মেয়েরা ঘরে ঘরে করছে তুঁষতুষলি ব্রত । রোজ ভোরে স্নান সেরে কাচা কাপড় পরে গাইছে ,"
" তোষলা গো রাই ,
তোমার দৌলতে আমরা ছ'বুড়ি পিঠে খাই।"
পৌষ মাসে কিছু পূজাও হতো,
যেমন
বৌ ও মেয়েরা দল বেঁধে পৌষলক্ষ্মী অরুণার পুজো করতেন।
ঘর ঝেড়ে পুছে , তোরঙের সব গরমকাপড় রোদে দিয়ে ভালো করে রোদ লাগিয়ে গুছিয়ে রাখতো ।
তারপরে হতো বসুমতী পুজো । তুলসীমঞ্চে আলপনা দিয়ে ফল মিষ্টি আর বাস্তুসাপের জন্য দুধ রেখে ধূপ দীপ জ্বালিয়ে পুজো হতো। এরপর ক্ষেত্রপাল , নগরপালের ধ্যান করে বারবার তিনবার বলতে হয়--
"ঔ বাস্তুদেবায় নমঃ ।"
বাস্তুপুজো সেরে হবে শস্যোৎসব , আউনি-বাউনি পুজো । নতুন ধানের শীষের ছড়া দিয়ে শিষের বিনুনি করে বানাতে হয় আউনি আর বাউনি । তাকে সাজানো হয় মুলোর ফুল , সর্ষে ফুল , আমপাতা , তেল , হলুদ , সিঁদুর দিয়ে । নতুনধান তুলে ধানের গোলায় , ঢেঁকিশালে , বাক্স প্যাঁটরা তোরঙ্গে গুঁজে দিতে হয় আউনি আর বাউনিকে ।আর আমাদের হাতে হাতে ঘুরত তিলকূট , চিনির মঠ , বুড়ির চুল ( হাওয়াই মেঠাই সে এক রোমান্টিক ব্যাপার) ।
বাচ্চারা হাতে হাতে, কদমা , ছোলা , মঠ খেয়ে সমস্ত দিন দৌড়া দৌড় খেলা মাঠে
ধুলো উড়িয়ে আনন্দে মাতোয়ারা ।
ওদিকে ঢেঁকিতে চিড়ে কুটতে কুটতে গান গাইতেন---
"এসো পৌষ যেওনা,
ভাতের হাঁড়িতে থাকো পৌষ যেও না ,
পৌষমাস লক্ষ্মীমাস যেওনা .... "
তার পরে মনে পড়ে পৌষের কেঁদুলীর বাউল মেলা। কেঁদুলীতে জয়দেবের মেলায় দলে দলে হাটুরে মানুষ চলেছে , আউল বাউল ফকির নিকিন্নি সবাই ।
সে এক অতিসুন্দর ও অদ্ভুত মেলা।
কতো যে বাউল আছেন সেটা বোঝা যায় এই কেঁদুলীর মেলায়।
ওদিকে চলছে ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া , দুপুরে উড়বে ঘুড়ি । দক্ষিনয়নান্ত । উত্তরায়ণের সূচনায় ঘুড়ি উড়িয়ে সুয্যিদেবকে পেন্নাম জানাবে সবাই ।
আজ শেষবারের মতন হবে মূলোর ছেঁচকি , কারণ মাঘমাসে মূলো খেতে নেই , ,(খনার বচন) ।
" পিঠে গড়তে গড়তে বড়রানীর চোখ থেকে জল পড়ে । রাজপুত্তুর কোন দূরদেশে গেছে পড়াশোনা করতে । সঙ্গী রাজামশাই । শূন্য ঘর , খাট , বিছানা । রানী খায় না , কিছু খেতে গেলেই মনে হয় , আহা , ছেলেটা বড় ভালোবাসতো ! বিদেশ বিঁভুইতে আউলা ঝাউলা খাইয়া বাপ ব্যাটায় দিন কাটায় । আশেপাশের সব বাড়িতে পিঠার ধুম । বড়রানী চোখমুছে প্রথম পিঠা বিলাইকে দেয় , মনে করে ছেলেকে দিল । পরেরটাও দেয় , ভাবে রাজামশাই খেল । সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে শাঁখ বাজে , প্রদীপ জ্বলে , সবার বাড়িতে হইহই ।"
"পৌষমাসে পিঠেপুলি , মহা ধুমধাম
ঘরে ঘরে পিঠে গড়ে , ধন্য পল্লীগ্রাম
দুধপুলি, গুড় পিঠে , নারিকেল আর
সকলে করিছে পিঠে সকলপ্রকার ।"
( লক্ষ্মণ ভান্ডারী )
"সব ঘরে আলো জ্বলে , পিঠে হয় , মহাধুমধাম । বড়রানী পিঠে গড়ে , একখান তার পোলার নাম , একখান বরের নাম ।"
ঋণ : বাংলার ব্রতকথা , অবনঠাকুর।
<---আদ্যনাথ রায় চৌধুরী--->
==========================