Monday, October 28, 2024

53> শিক্ষা কি?

     53> শিক্ষা কি?—

অতি সাধারণ সংকীর্ণ অর্থে বিদ্যালয়ে অর্জিত জ্ঞান বা কৌশলকে শিক্ষা বলা হয়।

কিন্তু শিক্ষা কি?—এ প্রশ্নের সহজ উত্তর দিয়েছেন প্রেমেশ মহারাজ : “যা শিখলে সমগ্র জীবন সুখময় হয়, তাই শিক্ষা। যাতে বাল্যের আনন্দ যৌবনে নিরানন্দে পরিণত না হয়, যৌবনের সুখ প্রৌঢ় বয়সে এবং প্রৌঢ় বয়সের সুখ বার্ধক্যে দুঃখের হেতু না হয় সেটাই সঠিক শিক্ষা।

যা দুঃখ দূর করে, সুখ বৃদ্ধি করে এবং সুখকে স্থায়ী করতে সক্ষম, 

তাকেই বলি শিক্ষা।


আমাদের স্বামিজী বলেছেন, "যাতে মানুষের অন্তরের পূর্ণতা বিকশিত হয়, তাই-ই শিক্ষা।”

‘আত্মবিকাশ’-এর সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন :

“শরীর, প্রাণ, মন ও বুদ্ধির সমভাবে প্রকাশই প্রকৃত শিক্ষা—এক কথায় ইহাই মানুষের আত্মবিকাশ।



 যাহার এইরূপ শিক্ষালাভের সুযোগ হইয়াছে, অর্থাৎ যে-ব্যক্তি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, যে যথার্থই প্রাণবান,

 মননশীল ও বুদ্ধিমান তাহাকেই আমরা ঠিক ঠিক শিক্ষিত ও সভ্য বলিব।


 আর একটি জিনিস লক্ষ্য করিবার যে, এইরূপ শিক্ষিত ব্যক্তিরই সুখ-দুঃখের অনুভূতি এবং সৌন্দর্যবোধ প্রবল হয়। এইরূপ অনুভূতিশীল ও সূক্ষ্মবোধসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা যে-সমাজে যতো অধিক, সেই সমাজই ততো বেশি সভ্য সমাজ।"

                (সংগৃহীত)

==========================

কেউ মনেকরেন শিক্ষা হল জ্ঞানলাভের একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয়া হয় এবং তাকে সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সব দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলি অর্জনে সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে দক্ষতা বা জ্ঞান অর্জনই হল শিক্ষা। 


যুগে যুগে নানা মনীষী নানাভাবে শিক্ষা সংজ্ঞায়িত করেছেন । আবার সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার সংজ্ঞা বা ধারণা ও পদ্ধতিতে পরির্বতন এসেছে।



শিক্ষা শব্দটি এসেছে ‍'শাস' ধাতু থেকে, যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। 

সাধারণভাবে বলা যায় মানুষের আচরণের কাঙ্ক্ষিত, বাঞ্চিত এবং ইতিবাচক পরির্বতনই হলো শিক্ষা।


আবার  ইংরেজিতে শিক্ষার  প্রতিশব্দ এডুকেশন এসেছে লাতিন শব্দ এডুকেয়ার বা এডুকাতুম থেকে, যার অর্থ বের করে আনা অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা।


সক্রেটিসের ভাষায় “শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ। 

এরিস্টটল বলেন “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা”

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “শিক্ষা হল তাই, যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না; বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকেও গড়ে তোলে।


ইংরেজিতে ব্যাকরণগতভাবে, "এডুকেশন" শব্দটি লাতিন ēducātiō (যার অর্থ প্রজনন এবং লালন পালন করা), ēducō (যার অর্থ আমি শিক্ষাদান করি, আমি প্রশিক্ষণ দেই) যা হোমোনিম ēdūcō এর সাথে সম্পর্কিত (যার অর্থ আমি এগিয়ে নিয়ে যাই, আমি উত্থাপন করি) এবং Dōcō ( যার অর্থ আমি নেতৃত্ব দেই, আমি পরিচালনা করি ) থেকে উৎপত্তি হয়েছে।



আদিমকালে মানুষ ছিল অসহায়। ঝড়, বৃষ্টি, গরম, ঠাণ্ডা, ভূমিকম্প, বজ্রবিদ্যুৎ ইত্যাদি প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাকে সবসময় লড়াই করতে হয়েছে। মানুষ তখন প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকত ভয়ে। প্রকৃতি ছিল যেন প্রভু, আর মানুষ তার দাস। হিংস্র বন্যপ্রাণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে মানুষকে। গুহামানব বন্য পশু মেরেছে পাথর ছুঁড়ে। শিকার করা পশুর কাঁচা মাংস খেয়েছে। বনের ফল মূল ছাড়াও যে মাংস খেয়ে খিদে মেটানো যায় এই চেতনা মানুষের মনে জাগ্রত হয়েছে। পাথর ছুঁড়ে তার 'জ্ঞান' হয়েছে এই পাথর দিয়েই পশুকে তাড়ানো যায় এমনকি মেরে ফেলা যায়। আদিম মানুষের মনে 'বোধ' এসেছে যে পাথরের আঘাতে পশু মরে যেতে পারে। এই বোধ থেকে তার মনে এসেছে অন্য পশুকে পাথর ছুঁড়ে মারার পরিকল্পনা। অর্থাৎ অন্য পশুর উপর পাথর 'প্রয়োগ' করে তা মারার চেষ্টা। পাথর তো ভোঁতা হলে পশু শিকার করার অসুবিধে হয়। এটাকে যদি ধারালো বা সূঁচালো করা যায় তাহলে পশু ঘায়েল করতে খুবেই সুবিধে হয়। তাই পাথর কেটে অস্ত্র তৈরি করতে তাঁর 'দক্ষতা' এসেছে। এভাবেই জ্ঞান, বোধ, প্রয়োগ, দক্ষতার হাত ধরে শিক্ষা এগিয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জনের উৎস সম্বন্ধে সংস্কৃত সাহিত্যে বলা হয়েছে,-


"আচার্যাৎ পাদম্ আধত্তে পাদম্ শিষ্যঃ স্ব-মেধয়া; পাদম্ স্ব-ব্রহ্মচারিভ্যঃ পাদম্ কালক্রমেন চ।"


ব্রহ্মচারী বা শিক্ষার্থী জ্ঞানের এক চতুর্থাংশ লাভ করে আচার্য বা শিক্ষকের কাছ থেকে এক চতুর্থাংশ অর্জন করে নিজস্ব বুদ্ধিতে। এক চতুর্থাংশ লাভ করে অন্যান্য শিক্ষার্থীর সাথে আলাপ আলোচনায়। বাকি অংশ তার সমগ্র জীবন কর্মধারায় অর্জিত হয়। মানুষের জীবন এই বিশ্ব প্রকৃতির প্রাকৃতিক পরিবেশে আবৃত। মানুষের জীবন ও কর্ম বহুলাংশে নির্ভর করে প্রকৃতির উপর। বর্তমানে চার দেওয়ালে ঘেরা ব্যবস্থাকে বাদ দিয়েও শিক্ষা অর্জনের ভূমিকায় ব্যাপক ভাবে অংশ নিয়েছে প্রকৃতি-বিশ্বপ্রকৃতি। বিশ্বপ্রকৃতি যেন একজন মহান শিক্ষক। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ঘাত প্রতিঘাতে আবৃত করে রাখে প্রকৃতি। মানুষকে ক্রিয়াশীল করে প্রকৃতি। প্রকৃতিতে আছে দুরকম বস্তু। জীব এবং জড়। জীব ও জড়ের প্রভাব সব সময়ই আবর্তিত হয় মানবজীবন প্রবাহে। তাই প্রকৃতি কোন নিষ্ক্রিয় সত্তা নয় তারও রয়েছে যেন জীবনী শক্তি! শিক্ষাবিদ রুশো বলেছেন, "Everything is good as it leaves the hand of the author of nature, everything is degenerated in the hands of man"[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] সব কিছুই ভালো যা প্রকৃতি করে। মানুষের হাতে সব কিছু যেন ধ্বংস হয়। প্রকৃতির ক্রিয়াকলাপ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপলব্ধির মাধ্যমে যে শিক্ষা ঘটে তা হল প্রকৃত শিক্ষা।



প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবনে শিক্ষা কথাটি জড়িয়ে রয়েছে। মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল প্রকার অগ্রগতির পেছনে যে উপকরণ কাজে লাগে তা হল শিক্ষা। ব্যক্তির সুষ্ঠু জীবন যাপন সামাজিক উন্নয়ন এবং সভ্যতার অগ্রগতির জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষা অতীতের সংস্কৃতিকে বহন করে, বর্তমান সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং ভবিষ্যতের প্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু শিক্ষা কি? আধুনিক চিন্তাবিদ এবং বিজ্ঞানীরা মনে করেন শিক্ষা এক ধরনের গতিশীল কাজ। অনেক সময় জ্ঞানার্জনকে স্বাভাবিক ভাবে শিক্ষা বলা হয়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি যত জ্ঞান অর্জন করেছেন তাঁকেই আমরা তত শিক্ষিত বলি। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- "Education is the menifestation of perfection already in man."  রুশোর মতে- "Education is the unfoldment of the child. It is the skill of human behavier pattern."[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] সক্রেটিস বলেছেন - "Education is self realisation."


সংকীর্ণ অর্থে বিদ্যালয়ে অর্জিত জ্ঞান বা কৌশলকে শিক্ষা বলা হয়। কিন্তু কোনো মনোবিদ বা কোনো বিজ্ঞানী বিদ্যালয়ের অর্জিত জ্ঞানকে প্রকৃত শিক্ষা বলতে চাননি। বর্তমান কালে শিক্ষার ব্যাপক অর্থ খুবই কার্যকরী। শিক্ষা বিদরা মনে করেন শিক্ষা এক ধরনের জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া যা মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলে। শিক্ষা কি? শিক্ষার ব্যাপক অর্থ হল:শিক্ষা মানুষের জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে সবসময়ই তার শিক্ষা চলে। এটি এক সামাজিক প্রক্রিয়া। সমাজ ছাড়া শিক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না। শিক্ষা হলো মানুষের অভিজ্ঞতার পুর্নগঠন ও পূর্ণসৃজন। যা বাস্তব সমস্যার সমাধানে সাহায্য। যা কোনো প্রাণীর আচরণের পরিবর্তন আনে তাই শিক্ষা। শিক্ষাই মানুষের সামাজিকীকরণে সাহায্য করে সমাজ সংরক্ষণ করে। যে কৌশল সমাজ ও ব্যক্তির মঙ্গল করে তাই শিক্ষা। এটি ক্রমবিকাশের ধারাকে বহন করে।শিক্ষা একধরনের উভমুখী প্রক্রিয়া যার সাহায্যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পারস্পরিক ভাবের আদান প্রদান চলে এবং এর ফলে উভয়ই উপকৃত হয়। শিক্ষা হল ব্যক্তির জ্ঞানমূলক, সামাজিক, মানসিক, এমনকি ব্যক্তিগত দিকের সর্বাঙ্গীন বিকাশের জীবনব্যাপী চলমান প্রক্রিয়া। যেহেতু শিক্ষা গতিশীল তাই এর অর্থ এমনকি লক্ষ্য- যুগ থেকে যুগান্তর সভ্যতার অগ্রগতির সাথে পরিবর্তিত হয়েছে।

===========================